
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে দীর্ঘ ছয় মাস বন্দী থাকার পর অবশেষে নিজ দেশে ফিরেছেন ভারতীয় নাগরিক সালাইন হোসেন। মাত্র ১৫ দিনের সাজা প্রাপ্ত এই যুবক আইনি জটিলতার কারণে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রায় অর্ধ বছর কাটিয়েছেন বাংলাদেশের একটি কারাগারে। এই কঠিন পরিস্থিতির অবসান ঘটে এক মানবিক ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তির সহানুভূতির উদ্যোগে—যিনি সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত হলেও সমাজে ‘বাংলাদেশের বজরঙ্গি ভাইজান’ নামে খ্যাত হয়েছেন। তিনি শামসুল হুদা।
পেছনের গল্প: ছোট অপরাধ, দীর্ঘ বন্দিত্ব
সালাইন হোসেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পাহাড়ি জেলা দার্জিলিংয়ের বাসিন্দা। প্রয়াত হামিদ হোসেনের সন্তান সালাইন কাজের খোঁজে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের বেঙ্গালুরু শহরে পাড়ি জমান। কিন্তু সেখান থেকে হঠাৎই তার যাত্রাপথ মোড় নেয় অনিয়মিত পথে। বেঙ্গালুরু থেকে মালদা হয়ে তিনি অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন, মূলত জীবিকার সন্ধানে। ঢাকায় এসে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ শুরু করেন তিনি।
কিন্তু ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে সালাইন ভয় পেয়ে যান এবং নিরাপত্তার চিন্তায় ভারতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে সীমান্ত পার হওয়ার আগেই ধরা পড়েন তিনি এবং বাধ্য হয়ে ২৯ জুলাই রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় আত্মসমর্পণ করেন।
তার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা হয় এবং আদালত তাকে ১৫ দিনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি। যেহেতু তিনি আগে থেকেই কারাগারে ছিলেন, তার শাস্তি কার্যত ১৪ ডিসেম্বরেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আইনি এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে তিনি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকে থাকেন আরও সাড়ে চার মাস। মূল সমস্যা ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ভারতীয় হাইকমিশনের ছাড়পত্র না পাওয়া।
এগিয়ে আসেন শামসুল হুদা
এই অবস্থায় ২২ ফেব্রুয়ারি মানবিক সাংবাদিক শামসুল হুদা সালাইনের বিষয়ে জানতে পারেন। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দেশের আটকে পড়া নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরাতে কাজ করে আসা এই সাংবাদিক আবারও একটি উদ্যোগ নেন। শামসুল হুদা নিজেই যোগাযোগ শুরু করেন স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে। প্রতিটি দপ্তরে গিয়ে সালাইনের বিষয়ে বারবার আবেদন ও অনুসন্ধান করেন তিনি।
এই প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগে প্রায় দুই মাস। অবশেষে ২১ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র আসে। এরপর দ্রুত সমস্ত কাগজপত্র ও ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তিনি নিজে রাজশাহীতে গিয়ে প্রত্যার্পণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
দেশে ফেরা এবং সীমান্তে মিলন
২০২৫ সালের ১১ মে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে সব আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সালাইন হোসেনকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই সময় উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের কর্মকর্তারা, ইমিগ্রেশন পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর সদস্যরা।
সালাইনের পরিবারের পক্ষ থেকে তার ভাই ফয়সাল হোসেন সীমান্তে এসে তাকে গ্রহণ করেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে দুই ভাইয়ের পুনর্মিলন ছিল আবেগঘন এবং স্বস্তিদায়ক দৃশ্য।
মানবিক দায়িত্ববোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
শামসুল হুদা এক সাক্ষাৎকারে জানান, সালাইনকে দেশে ফিরিয়ে দিতে পেরে তিনি আন্তরিকভাবে আনন্দিত। তিনি বলেন, “মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই আমি এই কাজগুলো করি। মানুষ ভুল করতেই পারে, কিন্তু সেটার জন্য তাকে বছরের পর বছর শাস্তি পেতে হবে—এটা কোনো সভ্য সমাজে কাম্য নয়।”
তিনি আরও বলেন, অনেক ভারতীয় নাগরিক বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে এসে আটকে পড়েন। আবার বাংলাদেশিরাও একইভাবে ভারতে আটক হন। এমন সব নাগরিকদের ফেরাতে দুই দেশের প্রশাসন আরও সমন্বিত ও দ্রুত ব্যবস্থা নিলে অনেক কষ্টের অবসান ঘটতে পারে।
সালাইন হোসেনের দেশে ফেরা শুধু একজন যুবকের মুক্তির গল্প নয়, বরং এটি একজন সাহসী ও মানবিক সাংবাদিকের নিরলস প্রচেষ্টারও প্রতিচ্ছবি। ‘বাংলাদেশের বজরঙ্গি ভাইজান’ নামে পরিচিত শামসুল হুদা প্রমাণ করেছেন, ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং দৃঢ় সংকল্প থাকলে যেকোনো কঠিন ব্যবস্থাপনার জটিলতা পেরিয়ে মানুষকে তার আপন ঠিকানায় ফেরানো সম্ভব। সালাইনের গল্প তাই শুধুই একটি সংবাদ নয়, এটি মানবতার এক জীবন্ত অনুরণন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ