
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ ফুসফুসজনিত রোগে ভুগছেন, যার মধ্যে হাঁপানি অন্যতম পরিচিত এবং সাধারণ একটি দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা। হাঁপানির বিভিন্ন কারণ, লক্ষণ এবং কখন এই রোগকে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত—তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। কারণ অনেক সময় আমরা লক্ষণগুলোকে অবহেলা করি বা অন্য কোনো রোগের উপসর্গ মনে করে চিকিৎসা বিলম্ব করি, যা পরিণামে বিপজ্জনক হতে পারে।
হাঁপানি কী?
হাঁপানি বা অ্যাজমা (Asthma) একটি দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যার ফলে ফুসফুসের বায়ুনালীগুলোতে (airways) প্রদাহ এবং সংকোচন ঘটে। এতে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং রোগী হাঁপানির ধরণের শব্দযুক্ত শ্বাস নেয়। এটি হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে—যা অ্যাজমা অ্যাটাক বা হাঁপানির তীব্র আক্রমণ হিসেবে পরিচিত। এ সময় দ্রুত চিকিৎসা না নিলে তা প্রাণঘাতীও হতে পারে।
হাঁপানির প্রধান কারণগুলো কী?
১. অ্যালার্জি:
হাঁপানির অন্যতম প্রধান কারণ অ্যালার্জি। ধুলোর কণা, গৃহপালিত প্রাণীর লোম, ঘরের ছত্রাক বা ছাঁচ, পোকামাকড়, এমনকি গাছের পরাগরেণু বা ফুলের গন্ধ থেকেও অনেকের হাঁপানির উদ্ভব হতে পারে। যাদের শরীরে অ্যালার্জেনের প্রতি অতিসংবেদনশীলতা রয়েছে, তারা খুব সহজেই আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
২. পারিবারিক ইতিহাস:
বংশগতভাবেও হাঁপানি হতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথ্যমতে, যদি একজন বা উভয় অভিভাবক হাঁপানির রোগী হন, তবে সন্তানের মধ্যে হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তিন থেকে ছয় গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
৩. ধূমপান ও পরোক্ষ ধূমপান:
সিগারেটের ধোঁয়া হাঁপানির অন্যতম শত্রু। এটি শুধু যে ধূমপায়ীর জন্য ক্ষতিকর তা নয়, বরং তার আশেপাশে থাকা ব্যক্তিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। গর্ভাবস্থায় ধূমপান করা নারীর গর্ভস্থ সন্তানও ভবিষ্যতে হাঁপানির ঝুঁকিতে পড়তে পারে। শিশুকাল থেকেই এই ক্ষতি শুরু হয়।
৪. ভাইরাল ইনফেকশন বা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ:
শৈশবে কোনো শিশু যদি নিয়মিত ভাইরাল শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে ভোগে, তবে বড় হয়ে তার হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। অনেক সময় RSV (Respiratory Syncytial Virus) জাতীয় ভাইরাস এসব সমস্যার জন্ম দেয়।
৫. পরিবেশ দূষণ ও নগরায়ন:
শহরের বায়ুদূষণ, যানবাহনের ধোঁয়া, রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শ এবং আবাসিক এলাকার পরিবেশগত অবনতি হাঁপানির অন্যতম বড় কারণ। গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলের শিশু ও বড়রা বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
কোন লক্ষণগুলো হাঁপানির?
হাঁপানির লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে শুরু হতে পারে কিংবা হঠাৎ করেও দেখা দিতে পারে। যেসব লক্ষণকে প্রাথমিকভাবে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়, তা নিচে বিস্তারিতভাবে দেওয়া হলো:
১. শ্বাসকষ্ট বা দ্রুত শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া:
সাধারণত হাঁপানির সময় মানুষ ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারেন না। শ্বাস আটকে আসে এবং দীর্ঘ সময় ধরে শ্বাস নিতে সমস্যা হতে থাকে। রাতে কিংবা ভোরবেলা এ সমস্যা বেশি হয়।
২. ইনহেলার ব্যবহার করেও উন্নতি না হওয়া:
যখন কোনো হাঁপানি রোগী নিয়মিত ইনহেলার ব্যবহার করেও স্বস্তি পান না বা শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে, তখন বুঝতে হবে পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠছে।
৩. কাজ না করেও ক্লান্তি ও শ্বাসকষ্ট হওয়া:
সাধারণ দৈনন্দিন কাজ যেমন হাঁটা, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা বা হালকা গৃহকর্ম করলেও যদি শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা জরুরি।
৪. বুকের পেশির টান বা প্রসারণ:
শ্বাস নিতে গিয়ে বুকের পেশিগুলো অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে বা টান লাগে—এটিও একটি স্পষ্ট লক্ষণ। এটি হাঁপানির তীব্র অবস্থাকে নির্দেশ করে।
৫. অতিরিক্ত ঘাম হওয়া:
শরীর অতিরিক্ত ঘামতে শুরু করলে, বিশেষ করে শ্বাসকষ্টের সময়—তা নিঃসন্দেহে সতর্ক সংকেত। এটি হাঁপানির পাশাপাশি অক্সিজেন ঘাটতির লক্ষণও হতে পারে।
৬. ঠোঁট, নখ বা মুখ ফ্যাকাশে/নীল হয়ে যাওয়া:
এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক লক্ষণগুলোর একটি। শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পৌঁছালে ঠোঁট ও নখের রঙ পরিবর্তিত হতে থাকে। এই অবস্থায় দেরি না করে জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন।
হাঁপানি থাকলে কী করবেন?
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বা ইনহেলার পরিবর্তন করবেন না।
অ্যালার্জেন থেকে নিজেকে দূরে রাখুন।
ঘর পরিষ্কার রাখুন, ধুলাবালি এড়িয়ে চলুন।
ধূমপান পরিহার করুন এবং ধূমপায়ী পরিবেশ থেকেও দূরে থাকুন।
বায়ু দূষণের দিনগুলোতে বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করুন।
নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থাকুন এবং প্রয়োজনে শ্বাস পরীক্ষা (Spirometry) করান।
হাঁপানি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ হলেও অবহেলা করলে তা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। অনেক সময় রোগীরা বারবার হালকা লক্ষণগুলো উপেক্ষা করেন, যার ফলে বিপদের সময় তারা প্রস্তুত থাকেন না। তাই হালকা উপসর্গ দেখা দিলেই সচেতন হতে হবে, নিয়মিত চিকিৎসা ও জীবনযাপনের পরিবর্তন আনতে হবে। সচেতনতাই হাঁপানি প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ