
ছবি: সংগৃহীত
মানব ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ও মরণঘাতী রোগ হিসেবে পরিচিত এইডস (AIDS) বা 'অ্যাকুয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম'-এর চিকিৎসায় অবশেষে আশার আলো দেখছেন গবেষকরা। ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি (ইএমএ) সম্প্রতি দুটি নতুন ওষুধের অনুমোদন দিয়েছে, যেগুলো ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করে এইচআইভি সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে। এই ওষুধগুলো যদি কার্যকর প্রমাণিত হয়, তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি হতে পারে এক যুগান্তকারী অগ্রগতি।
এইচআইভি (হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) একবার মানবদেহে প্রবেশ করলে তা প্রথমেই আক্রমণ করে রোগপ্রতিরোধী ব্যবস্থা, বিশেষ করে ‘টি-কোষ’ নামক প্রতিরক্ষামূলক কোষগুলোকে। এই ভাইরাসের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হচ্ছে, এটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিজের জিনগত গঠন বদলে নিতে পারে এবং সংক্রমিত কোষগুলোতে বিভাজনের মাধ্যমে দ্রুত বাড়তে থাকে। ফলে রোগীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। একসময় সাধারণ কোনো সংক্রমণও তার জীবনের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এইডস রোগীদের দীর্ঘদিন ধরে প্রতিদিন নির্ধারিত সময় ও মাত্রায় অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ সেবন করতে হয়, যা কেবল ভাইরাসের বিস্তার কিছুটা কমাতে পারে, কিন্তু সম্পূর্ণ নির্মূল করতে পারে না। সেইসঙ্গে নিয়মিত ওষুধ গ্রহণের ফলে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। এতে রোগীরা মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, যা চিকিৎসার ধারাবাহিকতায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এই প্রেক্ষাপটে, নতুন দুটি ওষুধ— রিলপিভিরিন (Rilpivirine) ও ক্যাবোটেগ্রাভির (Cabotegravir)— চিকিৎসকদের নতুন করে আশাবাদী করেছে। উভয় ওষুধই অ্যান্টিভাইরাল শ্রেণির। এগুলোকে নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হবে। প্রথম ডোজ নেওয়ার এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ, এরপর প্রতি দুই মাস অন্তর একটি করে ইনজেকশন দিলেই চলবে। গবেষকদের আশা, এভাবে নিয়মিত ইনজেকশন গ্রহণ করলে প্রতিদিন মুখে ওষুধ খাওয়ার ঝক্কি থাকবে না, এবং রোগীর শরীরে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।
ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি জানিয়েছে, প্রাথমিক ট্রায়ালে ওষুধ দুটি ভালো ফল দেখিয়েছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রাও এখন পর্যন্ত সহনীয়। বর্তমানে ওষুধগুলো চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে। শিগগিরই তা সরাসরি রোগীদের ওপর প্রয়োগ করে কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা যাচাই করা হবে।
গবেষকরা মনে করছেন, এই ওষুধগুলোর মাধ্যমে এইচআইভি আক্রান্ত রোগীদের জীবনযাপন অনেক সহজ হবে। শুধু তাই নয়, এই পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ রোধেও বড় ভূমিকা রাখতে পারে, কারণ মুখে ওষুধ খাওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মের যে ঝুঁকি রয়েছে, ইনজেকশন-ভিত্তিক চিকিৎসায় তা অনেক কম।
তবে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, এই ওষুধ এইডসকে পুরোপুরি নিরাময় করতে পারবে না— এটি কেবল সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে, রোগীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে। এখনো এইচআইভিকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার মতো কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। তবে নতুন ওষুধের কার্যকারিতা দীর্ঘমেয়াদে প্রমাণিত হলে একে ভবিষ্যতের অন্যতম প্রধান চিকিৎসা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
এইচআইভি ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করার পর ধীরে ধীরে শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে দেয়। এই রোগ দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। একসময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে পড়ে এবং রোগীর দেহে নানা জটিলতা দেখা দেয়। এই অবস্থাকে বলা হয় এইডস।
বর্তমানে বিশ্বের বহু দেশে এইচআইভি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানা ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি, জটিল ডোজ এবং প্রতিদিনের ওষুধ খাওয়ার বাধ্যবাধকতার কারণে অনেকেই নিয়ম মানতে ব্যর্থ হন। এ কারণে ভাইরাসের প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটে। নতুন ইনজেকশনভিত্তিক চিকিৎসা এই চক্র থেকে মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, “এই ইনজেকশন পদ্ধতি যদি নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হয়, তবে এটি হতে পারে এইচআইভি সংক্রমণ মোকাবিলার একটি গেমচেঞ্জার পদ্ধতি। রোগীর মানসিক চাপ কমবে, চিকিৎসা হবে সহজ, এবং নিয়মিত ডোজ না খাওয়ার কারণে ভাইরাস প্রতিরোধ ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কাও কমে যাবে।”
তবে তারা এটাও বলছেন, “চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের এখনো অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু ট্রায়াল এবং বড় আকারের জনস্বাস্থ্য গবেষণার ওপর। কিন্তু সম্ভাবনা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।”
এইডস চিকিৎসায় যুগান্তকারী এই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হলে বিশ্বের কোটি কোটি আক্রান্ত মানুষ পেতে পারেন নতুন জীবন ও স্বস্তির পথ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ