
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অনেক নারীর জন্য একটি বড় স্বাস্থ্যগত উদ্বেগের নাম হয়ে উঠেছে ‘জরায়ুর টিউমার’। অনেক সময় টিউমার শব্দটি শুনেই নারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, কারণ বেশিরভাগ মানুষই এটিকে সরাসরি ক্যানসারের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেন। অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে ভিন্ন কথা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন, জরায়ুতে টিউমার মানেই যে সেটি ক্যানসার হয়ে যাবে—এই ধারণা একেবারেই সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, অধিকাংশ টিউমারই অ-ক্যানসার জাতীয় এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ করলে তা নিরাময়যোগ্য।
জরায়ুর টিউমার আসলে কী?
জরায়ুতে যে কোষগুলোর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে এবং যেগুলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত আকার ধারণ করে, সেগুলোকেই সাধারণভাবে টিউমার বলা হয়। এটি দুই ধরনের হতে পারে—সস্নান (Benign) অর্থাৎ অ-ক্যানসারযুক্ত এবং ম্যালিগন্যান্ট (Malignant) অর্থাৎ ক্যানসারজাতীয়। জরায়ুর সবচেয়ে সাধারণ অ-ক্যানসার টিউমার হচ্ছে ফাইব্রয়েড (Fibroid), যাকে ‘ইউটারাইন লেইওমাইওমা’ও বলা হয়। এটি মূলত পেশির কোষ থেকে তৈরি হওয়া একটি বৃদ্ধি, যা বহু নারীর ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা ছাড়াই years পর years থেকে থাকতে পারে।
তবে এই টিউমার কখনো কখনো জটিলতাও তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে যখন এর আকার বড় হয়ে যায় বা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তখন এটি শারীরিক কষ্ট, প্রজনন সমস্যাসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, যে কোনও অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে বরং একজন গাইনোকোলজিস্ট বা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করা উচিত।
টিউমারের উপসর্গ কী কী?
জরায়ুতে টিউমার হয়েছে কিনা, তা বুঝে ওঠা সাধারণ নারীর জন্য খুব সহজ নয়। তবে কিছু লক্ষণ আছে যা দেখা দিলে সন্দেহ জাগে এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এগুলো হল—
অতিরিক্ত ঋতুস্রাব: টানা কয়েক মাস ধরে যদি ঋতুস্রাবের রক্তপাত মাত্রাতিরিক্ত হয়, রক্ত জমাট বাঁধে বা অনিয়মিত রক্তপাত হতে থাকে, তবে এটি টিউমারের একটি সম্ভাব্য লক্ষণ হতে পারে।
তলপেটে যন্ত্রণা বা চাপ অনুভব: বিশেষ করে ঋতুস্রাবের সময় এই ব্যথা প্রকট আকারে দেখা দিতে পারে। এটি অনেক সময় পেটের নিচের দিকে ভারী একটা অনুভূতির সৃষ্টি করে।
প্রজননে সমস্যা: অনেক সময় গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দেয়, বারবার গর্ভপাত হয় বা গর্ভাবস্থা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
মূত্রনালির সমস্যা: টিউমার বড় হলে মূত্রথলিতে চাপ দিতে পারে, যার ফলে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ বা মূত্রধারায় বাধা সৃষ্টি হতে পারে।
পিঠে ব্যথা বা কোমরের ব্যথা: বড় আকারের টিউমার শরীরের অন্যান্য অংশে চাপ সৃষ্টি করে এই ধরনের ব্যথার কারণ হতে পারে।
টিউমার মানেই ক্যানসার নয়
ঢাকার কয়েকজন অভিজ্ঞ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ জানান, জরায়ুর শতকরা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ টিউমারই ফাইব্রয়েড বা অ-ক্যানসারযুক্ত হয়ে থাকে। এগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও অনেক নারী তেমন কোনো উপসর্গ অনুভব করেন না। এসব ক্ষেত্রে ওষুধ সেবন বা পর্যবেক্ষণেই টিউমার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে টিউমারটি যদি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে, আকারে বড় হয়, অথবা উপসর্গ মারাত্মক আকার ধারণ করে, তখন অস্ত্রোপচার বা অপসারণ প্রয়োজন হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, অল্প কিছু টিউমার আছে যেগুলো পরে ক্যানসারে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি বহন করে। তবে এমন পরিস্থিতি খুব কমই দেখা যায় এবং আগেভাগে সনাক্ত করা সম্ভব হলে চিকিৎসার মাধ্যমে তা রোধ করা যায়।
চিকিৎসা কীভাবে করা হয়?
জরায়ুর টিউমার চিকিৎসায় প্রথম ধাপে সাধারণত ওষুধ ব্যবহার করা হয়। হরমোন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে টিউমারের বৃদ্ধি কমিয়ে আনা হয়। যদি এই পদ্ধতিতে কাজ না হয় বা রোগী বিশেষভাবে কষ্ট পেতে থাকেন, তখন অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমেও আবার টিউমার অপসারণ করা যায়, অথবা জটিল হলে পুরো জরায়ু অপসারণ করতে হতে পারে (হিস্টেরেকটমি)।
তবে চিকিৎসকরা জোর দিয়ে বলেন, প্রথম থেকেই সচেতনতা এবং নিয়মিত চেকআপই হতে পারে বড় বিপদ এড়ানোর একমাত্র উপায়। টিউমার ধরা পড়লেই ভয় না পেয়ে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করলে প্রায় সব ক্ষেত্রেই রোগ নিরাময় সম্ভব।
বারবার হতে পারে টিউমার
একবার টিউমার হলে ভবিষ্যতে আবার হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এজন্য চিকিৎসা শেষে নিয়মিত ফলোআপ, স্বাস্থ্যকর জীবনধারা, ব্যায়াম এবং পরিমিত খাদ্যাভ্যাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিছু গবেষণা বলছে, দীর্ঘদিন ওজন বৃদ্ধি, হরমোন ডিসব্যালেন্স, অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং অনিয়মিত ঋতুচক্র—এগুলো টিউমার বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
চিকিৎসকের পরামর্শ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
অনেক সময় নারীরা সামাজিক লজ্জা বা অজ্ঞতা থেকে শরীরের সমস্যাকে গোপন করেন। ফলে টিউমার বড় হয়ে জটিল আকার ধারণ করে। অথচ সময়মতো পরামর্শ নিলে এটি খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাই চিকিৎসকদের পরামর্শ—নিজের শরীরের প্রতি সচেতন হোন, উপসর্গ দেখলেই দেরি না করে চিকিৎসা নিন। জরায়ুর টিউমার মানেই ক্যানসার—এই ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ