
ছবি: সংগৃহীত
বিয়ে শুধু সামাজিক বা ধর্মীয় বন্ধন নয়—এটি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক মোড়। এই বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মানে শুধু একজন মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করা নয়, বরং একটি নতুন পরিবারের সূচনা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথচলার ভিত্তি তৈরি এবং দুজন মানুষের যৌথ জীবনের শারীরিক-মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা। আর তাই বিয়ের আগে নিজেদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া শুধু প্রাসঙ্গিক নয়, বরং অত্যন্ত জরুরি।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বহু বছর ধরেই Premarital Medical Check-Up অর্থাৎ বিয়ের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা একটি স্বীকৃত ও স্বাস্থ্যসম্মত প্রথা। বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে এই ধারণা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বিশেষ করে চিকিৎসকরা এখন বেশ জোর দিয়েই বিয়ের আগে নির্দিষ্ট কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এটি একদিকে যেমন দাম্পত্য জীবনের মান উন্নত করে, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ সন্তানদের জন্যও একটি নিরাপদ ও সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
কেন দরকার বিয়ের আগে মেডিকেল চেকআপ?
আমরা অনেকেই ভাবি, বিয়ের আগে শারীরিক পরীক্ষা করানো হয়তো একটি অপমানজনক বা সন্দেহমূলক বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। এটি কোনোভাবে অপমান নয়, বরং আত্ম-সচেতনতা, দায়িত্বশীলতা ও ভালোবাসার প্রতিফলন। যখন দুটি মানুষ দীর্ঘ সময় একসাথে কাটাতে যাচ্ছেন, তখন একে অপরের স্বাস্থ্যগত অবস্থা সম্পর্কে জানাটাও সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
প্রি-ম্যারিটাল চেকআপের মাধ্যমে যা জানা যায়:
সংক্রামক ও যৌনবাহিত রোগের ঝুঁকি
বংশগত রোগের বাহকতা বা সম্ভাবনা
সন্তান নেওয়ার সক্ষমতা ও প্রজনন স্বাস্থ্য
দীর্ঘমেয়াদি রোগের উপস্থিতি
মানসিক স্থিতিশীলতা ও রোগপ্রবণতা
এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আগেভাগেই জানা থাকলে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত হয় এবং দাম্পত্য জীবনে পরবর্তীকালে বড় কোনো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
বিয়ের আগে করিয়ে নিতে হবে যে ৭টি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা
১. হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস
এই পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য থ্যালাসেমিয়া রোগ শনাক্ত করা। থ্যালাসেমিয়া এমন একটি বংশগত রক্তজনিত রোগ, যার বাহক হলে বাহ্যিকভাবে তেমন কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু বর ও কনে উভয়ই যদি এই রোগের বাহক হন, তাহলে ভবিষ্যৎ সন্তান মারাত্মকভাবে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও জটিল হওয়ায় আগেই প্রতিরোধ করাই শ্রেয়।
২. ব্লাড গ্রুপিং ও Rh টাইপিং
রক্তের গ্রুপের পাশাপাশি Rh ফ্যাক্টর জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে নারীর Rh-নেগেটিভ ও পুরুষের Rh-পজিটিভ হলে সন্তান ধারণে জটিলতা দেখা দিতে পারে। এটি সময়মতো জানা গেলে চিকিৎসার মাধ্যমে এ জটিলতা দূর করা যায়।
৩. যৌনবাহিত রোগ শনাক্তকরণ (HIV, হেপাটাইটিস B ও C, সিফিলিস)
এসব রোগের মধ্যে কিছু দীর্ঘমেয়াদি ও প্রাণঘাতী হতে পারে, আবার কিছু অনাগত সন্তানের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে। এই পরীক্ষাগুলো করে চিকিৎসা শুরু করলে সংক্রমণ রোধ সম্ভব এবং সম্পর্ক ও ভবিষ্যৎ উভয়ই নিরাপদ থাকে।
৪. বন্ধ্যত্ব নির্ধারণ সংক্রান্ত টেস্ট
পুরুষের ক্ষেত্রে স্পার্ম কাউন্ট ও গতিশীলতা এবং নারীর ক্ষেত্রে হরমোনাল প্রোফাইল ও ডিম্বাশয়ের অবস্থা যাচাই করা হয়। সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা থাকলে এই পরীক্ষা অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে।
৫. বংশগত রোগ স্ক্রিনিং
বিশেষত আত্মীয় বিয়ের ক্ষেত্রে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বংশগত জিনগত রোগ, যেমন হেমোফিলিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, বা টেই স্যাকস ডিজিজের ঝুঁকি আগে থেকেই যাচাই করে নিতে হবে।
৬. দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা যাচাই (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েড)
এই রোগগুলো দাম্পত্য জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। স্ত্রী গর্ভধারণ করলে গর্ভকালীন সময়েও এসব রোগের প্রভাব পড়তে পারে শিশুর ওপর। আগে থেকে শনাক্ত করে চিকিৎসা নিলে দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা অনেকটাই এড়ানো যায়।
৭. মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন
একটি সফল দাম্পত্য জীবনের জন্য মানসিক সুস্থতা অপরিহার্য। বিষণ্ণতা, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক সমস্যাগুলো থাকলে তা আগে থেকেই চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় তা দাম্পত্য জীবন ও সন্তানের মানসিক সুস্থতাও প্রভাবিত করতে পারে।
প্রি-ম্যারিটাল চেকআপের ধাপগুলো কীভাবে এগোয়?
১. ডাক্তারের সঙ্গে প্রাথমিক পরামর্শ – পারিবারিক ইতিহাস, পূর্ববর্তী রোগের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি শেয়ার করা হয়।
২. শারীরিক পরীক্ষা – উচ্চতা, ওজন, রক্তচাপ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সূচক পরীক্ষা করা হয়।
৩. ল্যাব টেস্ট – উপরের সাতটি টেস্ট ছাড়াও কিছু অতিরিক্ত পরীক্ষা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে করা হতে পারে।
৪. জেনেটিক স্ক্রিনিং – বংশগত রোগের সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণ করা হয়।
৫. রিপোর্ট রিভিউ ও চিকিৎসকের সুপারিশ – রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে চিকিৎসক ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা মানেই সন্দেহ নয়, এটি সচেতনতার প্রতীক
আমাদের সমাজে এখনো অনেকেই বিয়ের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে এটি আত্মসচেতনতার প্রতীক। ভালোবাসার গভীরতা তখনই সত্যিকার হয়, যখন দুজন মানুষ একে অপরের প্রতি শারীরিক ও মানসিকভাবে দায়িত্ববান হন।
বিয়ের আগে এই সাতটি জরুরি পরীক্ষা শুধু নিজেকে নয়, আপনার প্রিয়জন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখার একটি চূড়ান্ত পদক্ষেপ। সম্পর্ক হোক বিশ্বাস, সততা ও সুস্থতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর সেই পথেই হোক সুদীর্ঘ সুখী দাম্পত্য জীবনের সূচনা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ