
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশের চার অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, সাংবাদিক ও লেখকের ইউটিউব চ্যানেল দেশটির ভেতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইউটিউবে নিষিদ্ধ হওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে রয়েছেন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও ব্লগার পিনাকী ভট্টাচার্য, সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন, প্রবাসী রাজনৈতিক ভাষ্যকার ড. কনক সরওয়ার এবং লেখক ও প্রযুক্তিবিষয়ক ব্লগার জুলকারনাইন সায়েরের চ্যানেল। শনিবার (১০ মে) রাতে পিনাকী ও জুলকারনাইন নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এ নিয়ে ভারতে ইউটিউব এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশি কনটেন্টের ওপর আরোপিত নিয়ন্ত্রণ আরও একধাপ কঠোর হলো। এর আগে শুক্রবার (৯ মে) ভারত সরকার ইউটিউব কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশের অন্তত চারটি টেলিভিশন চ্যানেলও প্ল্যাটফর্মে ব্লক করায়। চ্যানেলগুলো হলো—যমুনা টিভি, একাত্তর টিভি, বাংলাভিশন ও মোহনা টিভি। এসব চ্যানেল ভারতে ইউটিউবে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। সেখানে ভেসে উঠছে বার্তা: “এই ভিডিওটি ভারতের সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটি জাতীয় নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হতে পারে।”
ইউটিউবে তার চ্যানেল ব্লক করে দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে পিনাকী ভট্টাচার্য লেখেন, “আমার, ইলিয়াসের ও কনকের ইউটিউব চ্যানেল ব্লক করে দেওয়া হয়েছে ভারতে। ভারতমাতা তার শত্রুদের চিনে।” এরপর বাংলাদেশিদের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে কারা পিনাকী, ইলিয়াস আর কনকের শত্রু, তাদেরকে কি এখন চিনতে পারেন?”
পিনাকী দীর্ঘদিন ধরেই দেশের রাজনীতি, প্রশাসনিক দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ইউটিউব ও সামাজিক মাধ্যমে সরব ছিলেন। তার অনুসারী ও ভিউয়ার সংখ্যা বিপুল হলেও দীর্ঘদিন ধরেই তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন এবং সরকারের একাধিক মামলা-নির্যাতনের অভিযোগ করে আসছেন।
অপরদিকে ইউটিউব চ্যানেল ব্লক হওয়ার পর বিস্মিত প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকে জুলকারনাইন সায়ের লিখেন, “আমার অপরাধটা কিরে ভাই? কবে ইউটিউব চ্যানেল একটা খুলছিলাম, তেমন কিছুই পোস্ট করি না, ওইটাও ভরত মাতা তাগো দেশে ব্যান কইরা দিলো।”
জুলকারনাইন মূলত টুইটার, ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত বিষয়ে সক্রিয় থেকেছেন। তবে ইউটিউবে তার উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম হলেও চ্যানেলটি ভারতে ব্লক হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তিনি।
ভারতের ডিজিটাল নীতিনির্ধারণ বিষয়ক সংস্থা DisMisLab জানায়, ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের অধীনে সরকারের যদি কোনো তথ্য বা কনটেন্ট জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব বা জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি বলে মনে হয়, তাহলে ইউটিউব বা অন্য প্ল্যাটফর্মকে তা ব্লক করার আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে। বিশেষ করে Information Technology Act, 2000 এবং সংশ্লিষ্ট বিধিমালা অনুসারে (যেমন 2021 সালের ডিজিটাল মিডিয়া গাইডলাইন), সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এই আইনের ৬৯এ ধারার অধীনে কেন্দ্রীয় সরকার ‘public order’, ‘sovereignty of India’, ‘national security’, এবং ‘friendly relations with foreign states’—এই কারণ দেখিয়ে অনলাইন কনটেন্ট সরানোর নির্দেশ দিতে পারে।
এর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম X (সাবেক টুইটার) জানায়, ভারত সরকারের অনুরোধে প্ল্যাটফর্মে থাকা আট হাজার অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টের বেশিরভাগই ছিল রাজনৈতিক ভাষ্য, সংবেদনশীল সামাজিক ইস্যু ও মানবাধিকার নিয়ে সক্রিয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত এবং বাংলাদেশ—উভয় দেশের রাজনৈতিক বিভাজন ও তথ্যযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এসব কনটেন্ট ব্লকিং কেবল কৌশলগত সিদ্ধান্ত নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি মিডিয়া যুদ্ধের অংশ। বিশেষ করে এমন সময় এই সিদ্ধান্ত এলো যখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত, সরকারবিরোধী একাধিক বিদেশি প্রচারক উঠে এসেছে এবং দেশে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল ও বিতর্কিত বক্তাদের নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউটিউব চ্যানেল বা টেলিভিশন চ্যানেল ব্লক করলেও VPN বা বিকল্প প্রযুক্তির মাধ্যমে দর্শকরা অনেক সময় তা এড়িয়ে কনটেন্ট দেখতে পারেন। তবে এটি নিয়ন্ত্রণমূলক বার্তা দেয় এবং কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রীয় অবস্থানেরই প্রতিফলন।
এই চ্যানেলগুলো ভারতে বন্ধ হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার তথ্যপ্রবাহ ও মিডিয়া স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, কোনো কনটেন্ট জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি কিনা, তা নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ না করে শুধু সরকারের পক্ষ থেকে একতরফা সিদ্ধান্তে ব্লক করা হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ