
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অন্যতম প্রাচীন ও ক্ষমতাধর রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শনিবার (১০ মে) রাতে উপদেষ্টা পরিষদের এক বিশেষ বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভা শেষে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, আওয়ামী লীগ ও এর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির সব ধরনের কার্যক্রম—সরাসরি ও সাইবার প্ল্যাটফর্মে—নিষিদ্ধ থাকবে।
এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় একটি পরিপত্র সোমবার (১২ মে) জারি করা হবে বলে জানান তিনি।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে গুরুত্বপূর্ণ একটি সংশোধনীও অনুমোদন করা হয়। সংশোধনী অনুযায়ী, এখন থেকে ট্রাইব্যুনাল চাইলে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে সরাসরি শাস্তি দিতে পারবে। এই বিধানের আওতাতেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বৈঠকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের কর্মীদের নিরাপত্তা, এবং বাদী-সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়টি প্রধান বিবেচ্য হিসেবে উঠে আসে।
বিশেষ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরারসহ অন্যান্য মন্ত্রীপর্যায়ের উপদেষ্টারা।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি দীর্ঘ ৯ মাস ধরেই চলছিল। ‘সারডা সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠন গত বছর ১৯ আগস্ট এই মর্মে রিট করে, যদিও হাইকোর্ট তা খারিজ করে দেয়। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ও হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন দল ও জোট এই দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়।
বিশেষ করে, গত ১২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ কর্মীদের হামলায় ছাত্র নেতা আবুল কাশেম নিহত হলে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তাঁর লাশ ঘিরে শহীদ মিনারে জানাজা এবং 'ফ্যাসিবাদের কফিন মিছিল' নামে এক প্রতীকী প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়।
আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর (ওএইচসিএইচআর), আগেই সতর্ক করে বলেছিল—রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের মতো পদক্ষেপ বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনকে ব্যাহত করতে পারে। তাদের ৪৪ দফা সুপারিশের একটি ছিল—এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকা।
বিএনপি এ বিষয়ে বরাবরই সতর্ক বক্তব্য দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা জনগণের বিষয়, সরকারের একক সিদ্ধান্তে তা হলে ফল উল্টো হতে পারে। তারেক রহমান বলেছেন, “আওয়ামী লীগ দেশে অবৈধ সংসদ ও সরকার গঠন করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।”
মির্জা ফখরুল বলেন, “হাসিনা পালিয়েছে, কিন্তু তাঁর প্রেতাত্মারা এখনো ষড়যন্ত্র করছে।”
২০০১ সালের মতো বর্তমান পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ইতিহাসে বিরল নয়। ওই সময় জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার, যেটি তাদের স্বৈরাচারী পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিল। পরে সরকারের পতনের পর সেই আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের পটভূমি
আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে গত বছর ২৩ অক্টোবর নিষিদ্ধ করা হয় সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে। এ সিদ্ধান্তে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল তখন প্রশংসা করে বলেছিল, “এটি সাহসী পদক্ষেপ।”
এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য এবং বিতর্কিত অধ্যায় হয়ে রইল। ভবিষ্যতে ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরতে পারবে কি না—তা এখনই বলা যাচ্ছে না, তবে এই মুহূর্তে এটি দেশের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ