
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার শাহবাগ মোড় এখন নতুন করে একটি রাজনৈতিক বিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধসহ তিন দফা দাবিতে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো সেখানে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে একদল ছাত্র ও সাধারণ জনতা। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের নতুন উত্তেজনা ছড়িয়েছে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, যা শুরু হয়েছে সদ্যপ্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগকে কেন্দ্র করে।
শুক্রবার (৯ মে) বিকেল থেকে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভের মূল দাবি তিনটি—
১. আওয়ামী লীগের রাজনীতি চিরতরে নিষিদ্ধ করা,
২. “আওয়ামী শাসনামলের” বিচার দাবি করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, এবং
৩. স্বাধীনতার পর থেকে সংঘটিত রাজনৈতিক সহিংসতা ও গুম-খুনের তদন্তে জাতীয় কমিশন গঠন।
এই দাবিগুলো নিয়ে রাজধানীর ছাত্র-জনতা একত্রিত হয়ে শুক্রবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে শাহবাগ মোড়ে বিক্ষোভ শুরু করে। বিক্ষোভটি পরিচালনার জন্য পূর্বে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পাশের মঞ্চে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দেন। তিনি তার বক্তব্যে আওয়ামী লীগকে "একটি দুঃশাসনের প্রতীক" আখ্যা দিয়ে এ দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের জন্য জনমত গঠনের আহ্বান জানান।
তিনি আরো বলেন, “আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করেছে, বিচারব্যবস্থাকে দলীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে, এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে দলীয় সাইনবোর্ডে রূপান্তর করেছে। এবার জনগণই রায় দেবে।” তার ঘোষণার পরপরই বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিটে আন্দোলনকারীরা একটি বিশাল মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড় দখলে নেয় এবং সেখানে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে।
পুরো রাতজুড়ে শত শত আন্দোলনকারী শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয়। কেউ রাস্তার ওপর ব্যানার পেতে শুয়ে বিশ্রাম নেয়, কেউ কেউ গান, স্লোগান ও প্রতিবাদী বক্তৃতায় আন্দোলনের আবহ জিইয়ে রাখে। মধ্যরাতে মাইক থেকে শোনা যায়—“ব্যান ব্যান, আওয়ামী লীগ ব্যান”, “আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ”, “নতুন প্রজন্ম জাগো, গণতন্ত্র রক্ষা করো”—এমন নানা স্লোগান।
শনিবার (১০ মে) সকালেও আন্দোলনকারীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো, যদিও সারা রাত অবস্থানের কারণে সকালের সময়টায় লোকসমাগম কিছুটা কমে আসে। তবুও মোড়ে ছাত্রদের অবস্থান অব্যাহত থাকে। শাহবাগ মোড় ও এর চারপাশের সড়কগুলো ব্যারিকেড দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, ফলে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। শুক্রবারের মতো শনিবারও শাহবাগে তীব্র যানজট এবং বিকল্প রুটে গাড়ি চলাচলের ফলে রাজধানীর অন্যান্য এলাকাতেও প্রভাব পড়ে।
শনিবার রাত ১১টার দিকে হাসনাত আবদুল্লাহ আবারো বক্তব্য দেন। তিনি জানান, “এটা শুধু একটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নয়, এটা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে জাগরণ। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আগামীকাল (শনিবার) বিকেল ৩টায় শাহবাগেই বৃহত্তর গণজমায়েত হবে।” এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচি শেষ হলেও শনিবারও শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। বিশেষ করে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এমন সরাসরি নিষিদ্ধকরণের দাবি দেশের রাজনীতিতে বিরল। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এখনো এই আন্দোলনের বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি, তবে প্রশাসন সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানা গেছে।
এই আন্দোলন শুধু একটি দলীয় বিরোধের প্রকাশ নয়, বরং দেশের তরুণ সমাজের একটি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, যারা মনে করে যে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার আজ প্রশ্নবিদ্ধ। শাহবাগ আন্দোলন এক সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে জাতীয় আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। এবারও ছাত্র-জনতার এই নতুন জাগরণ কী পরিণতি বয়ে আনে, তা সময়ই বলে দেবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ