
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, “জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত ‘জাতীয় সনদ’ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে সংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত করবে। এই সনদ কেবল একটি রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং গোটা জাতির আকাঙ্ক্ষা ও সমন্বিত দায়বদ্ধতার প্রতিফলন।”
শনিবার (১০ মে) রাজধানীর সংসদ ভবনের লিডারস ডেলিগেট (এলডি) হলে আয়োজিত এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভায় তিনি এই মন্তব্য করেন। এদিন ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’ (ইউপিডিএফ)-এর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ধারাবাহিক সংলাপ পর্বের ২৮তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা শুরু হয় দুপুরে এবং প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী গঠনমূলক মতবিনিময় চলে।
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, “একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কেবলমাত্র তখনই গড়ে ওঠে, যখন সেখানে নাগরিক অধিকার অগ্রাধিকার পায়। নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমান সুযোগের নিশ্চয়তা, আইনের শাসন এবং একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা—এই চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে একটি কার্যকর ও ন্যায়ের সমাজ। জাতীয় সনদ এসব নীতির ভিত্তিতেই প্রস্তাবিত হয়েছে এবং আমরা মনে করি, এটি দীর্ঘকাল ধরে অনুপস্থিত যে রাজনৈতিক ও নৈতিক চুক্তির প্রয়োজন ছিল, সেটিকেই পূরণ করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “এই উদ্যোগ কেবল একটি দলীয় সংলাপ নয়। এটি জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো ও শাসনব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের জন্য এক সর্বজনীন অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া গড়ে উঠেছে। সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলসমূহকে যে খসড়া প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে এবং যা জনসমক্ষে উন্মুক্ত করা হয়েছে, তার মাধ্যমে আমরা একটি সুনির্দিষ্ট পথনকশা জাতির সামনে হাজির করেছি।”
“এই মুহূর্ত তৈরি হয়েছে বহু ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা এমন একটি অবস্থানে পৌঁছেছি যেখানে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ এবং অধিকতর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণ সম্ভব। এই সুযোগ হাতছাড়া করা মানে ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতার ব্যর্থতা।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বিশিষ্ট নাগরিক ও কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক সফর রাজ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
অন্যদিকে ইউপিডিএফ-এর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন দলটির ঢাকা অঞ্চলের সংগঠক মাইকেল চাকমা, দলের সদস্য সুনয়ন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি জিকো ত্রিপুরা এবং বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অমল ত্রিপুরা। আলোচনায় দলটির পক্ষ থেকে পার্বত্য অঞ্চল ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার, স্থানীয় প্রশাসনের স্বায়ত্তশাসন, পাহাড়ে মানবাধিকার পরিস্থিতি ও উন্নয়ন সংক্রান্ত নানা দাবি ও প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ইউপিডিএফসহ এ পর্যন্ত ২৮টি রাজনৈতিক দল এই কমিশনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপে অংশ নিয়েছে। প্রতিটি দলের কাছ থেকেই সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ করা হয়েছে।
কমিশনের সদস্যরা জানিয়েছেন, এই পর্বভিত্তিক সংলাপের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি জনগণতান্ত্রিক জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়ন করা, যা পরবর্তী সময় দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সর্বসম্মত চুক্তির রূপ নেবে এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করবে।
কমিশন আরও জানিয়েছে, সকল সংলাপ পর্যায়ের সারাংশ সংগ্রহ করে একটি ‘জাতীয় ঐকমত্য প্রতিবেদন’ তৈরি করা হচ্ছে, যা পরবর্তী ধাপে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সহযোগীদের কাছেও তুলে ধরা হবে। পাশাপাশি এই সনদ ভিত্তিক একটি অন্তর্বর্তীকালীন রূপান্তর পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে, যেখানে নির্বাচনী পদ্ধতির সংস্কার, বিচারিক স্বচ্ছতা ও প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা প্রাধান্য পাবে।
ড. আলী রীয়াজের বক্তব্যে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে, জাতীয় সনদ আর কেবল একটি কাগুজে প্রতিশ্রুতি নয়—এটি হতে যাচ্ছে জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের নতুন সামাজিক চুক্তি। “জনগণই হবে ক্ষমতার কেন্দ্র, এবং সব সিদ্ধান্তই হবে জনগণের কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে,” বলেন তিনি।
এই ঐক্যমত্যপ্রসূত উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে বলেই প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ