
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেশজুড়ে গণ-অভ্যুত্থানের ঢেউ উঠেছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও সংস্কারের দাবিতে। সে সময়ের উত্তাল আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল একটি জনবান্ধব, দায়িত্বশীল এবং দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ প্রশাসন। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে পুলিশ সদর দপ্তর পর্যন্ত সবার মুখে মুখে ছিল সংস্কারের অঙ্গীকার। পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে নতুন ধরণের পুলিশের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও মাঠপর্যায়ে এখনো সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া মেলেনি। বরং ঘুষ, চাঁদাবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশ আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
শ্রীপুর থানার ওসির বিরুদ্ধে ঝুট ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঘুষ চাওয়ার অডিও ফাঁস
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জয়নাল আবেদীন মণ্ডলের বিরুদ্ধে সম্প্রতি গুরুতর ঘুষ ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠে এসেছে। স্থানীয় এক ঝুট ব্যবসায়ী সেলিম সিকদারের সঙ্গে ওসির কথোপকথনের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়, যেখানে ওসিকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা বিনিময়ে কারখানা থেকে ঝুট মালামাল সরিয়ে নেওয়ার অনুমতি দিতে বলতে শোনা যায়।
সেলিম সিকদারের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি গ্রেপ্তারের দিন ওসিকে নগদ আড়াই লাখ টাকা ঘুষ দেন। বিষয়টি প্রকাশের পর ব্যাপক সমালোচনা হয়। গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ড. চৌধুরী যাবের সাদেক জানান, এই অভিযোগের তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট অডিও ক্লিপটি ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
কলাবাগান থানার ওসিসহ তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোটি টাকার চাঁদাবাজির অভিযোগ
ঢাকা মহানগরের কলাবাগান থানার ওসি মোক্তারুজ্জামান এবং এসআই আবু হুরায়রা জিহান ও বেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ড. আবদুল ওয়াদুদের কাছ থেকে কোটি টাকা চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ওসি ও দুই এসআইকে ইতিমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এস এন মো. নজরুল ইসলাম জানান, একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অভিযোগ যাচাই করা হবে।
নানা থানায় ঘুষ-চাঁদার ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন থানায় বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও ঘুষ নেওয়ার ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
নিচে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে নেওয়া শাস্তির চিত্র তুলে ধরা হলো:
টেকনাফ, কক্সবাজার: এসআই বদিউল আলমকে ৬ ফেব্রুয়ারি হুমকি দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগে পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করা হয়।
হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর: এসআই মাহফুজুর রহমানকে ঘুষ নেওয়ার ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় ১২ নভেম্বর বরখাস্ত করা হয়।
ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ: এসআই নজরুল ইসলামকে হত্যা মামলার আসামিকে ঘুষের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে ২৪ মার্চ বরখাস্ত করা হয়।
নাটোর সদর: এসআই আমিনুল ইসলামকে সেবাপ্রার্থীর কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়।
বিশ্বনাথ, সিলেট: এসআই আলীম উদ্দিনকে মামলার আসামিকে গ্রেপ্তার না করতে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে থানা থেকে সরিয়ে সিলেট পুলিশ লাইনে নেওয়া হয়।
পুলিশ সুপারদের প্রত্যাহার: কক্সবাজারের এসপি রহমত উল্লাহ, যশোরের এসপি জিয়াউদ্দিন আহমেদ, নীলফামারীর এসপি মোর্শেদ আলম এবং সুনামগঞ্জের এসপি আনোয়ার হোসেন খানকে ১৭ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ানোর অভিযোগে প্রত্যাহার করা হয়।
পুলিশের বক্তব্য: অভিযোগে কাউকে ছাড় দেওয়া হয় না
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) ইনামুল হক সাগর দাবি করেন, ‘‘যদি কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধ করে থাকেন, সেটিকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখি। প্রমাণ পেলে বিভাগীয় এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কাউকে ছাড় দেওয়া হয় না।’’
তবে বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। বহু আলোচিত অভিযোগের ক্ষেত্রে তদন্ত বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, আর অভিযুক্ত কর্মকর্তারা রদবদল বা সাময়িক বরখাস্তের আড়ালে থেকে যান বহাল তবিয়তে।
বিশেষজ্ঞদের মত: দায়মুক্তি বন্ধ না হলে সংস্কার অসম্ভব
টাঙ্গাইল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. উমর ফারুক বলেন, ‘‘যেসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাঁদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনিয়ম উৎসাহিত হয়। এতে সৎ ও নিষ্ঠাবান সদস্যদের মনোবলও ক্ষুণ্ন হয়।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘পুলিশ সদস্যরা জানেন, অপরাধ করলেও প্রভাব খাটিয়ে পার পাওয়া যায়। এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি যতদিন চলবে, ততদিন কোনো সংস্কার কার্যকর হবে না।’’
জনমনে প্রশ্ন: তবে কি সব প্রতিশ্রুতি মুখে মুখেই?
জনগণের প্রত্যাশা ছিল, গণ-আন্দোলনের পর পুলিশ প্রশাসনে কার্যকর সংস্কার আসবে। কিন্তু বিভিন্ন থানায় একের পর এক ঘুষ-চাঁদাবাজির অভিযোগ এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে ধীর ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের আস্থাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই লিখছেন, “পুলিশ বাহিনী পরিবর্তন হবে, বলেছিলেন নেতারা। কিন্তু আজও ওসি-এসআইদের টেবিলে 'রেট তালিকা'। তাহলে কিসের সংস্কার?”
অন্য একজন নাগরিকের মন্তব্য, “যদি সাহস করে কেউ প্রতিবাদ করে, তার নামে মিথ্যা মামলা হয়। তাহলে কি ভুক্তভোগীরা চুপ করে থাকবেই?”
সংস্কার চাইলে শুরু হোক শাস্তির দৃষ্টান্ত দিয়ে
একটি পেশাদার, জবাবদিহিতামূলক ও জনবান্ধব পুলিশ প্রশাসন গড়তে হলে দায়মুক্তি ও সুরক্ষার এই ঘেরাটোপ ভাঙতে হবে। প্রমাণিত অপরাধে অভিযুক্তদের বরখাস্ত নয়, বরং ফৌজদারি বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে যদি প্রশাসনের ভেতরের এই ‘অদৃশ্য চাঁদাবাজ নেটওয়ার্ক’ ভাঙা না যায়, তবে উন্নয়ন আর গণতন্ত্রের সব স্বপ্নই থেকে যাবে ফাইলবন্দি প্রতিশ্রুতির মধ্যে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ