
ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানের সামরিক অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির আশঙ্কায় একযোগে ৩২টি বেসামরিক বিমানবন্দর থেকে সব ধরনের ফ্লাইট চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। শনিবার (১০ মে) ভোরে ভারতের বেসামরিক বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এয়ারপোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া (এএআই) এবং বেসামরিক বিমান চলাচলের শীর্ষ সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব সিভিল অ্যাভিয়েশন (ডিজিসিএ) যৌথভাবে এক বিবৃতিতে এই সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ১৫ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে এসব বিমানবন্দর। মূলত ভারত-পাকিস্তান সীমান্তবর্তী এবং কৌশলগত গুরুত্বসম্পন্ন অঞ্চলগুলোর বিমানবন্দরগুলোকেই এই তালিকায় রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি দিল্লি ও মুম্বাই ফ্লাইট ইনফরমেশন রিজিওনের (FIR) আওতায় থাকা ২৫টি এয়ার ট্র্যাফিক সার্ভিস রুটও একই সময় পর্যন্ত সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।
নিরাপত্তা সতর্কতার অংশ হিসেবে বন্ধ করা বিমানবন্দরগুলো হলো: আধামপুর, আম্বালা, অমৃতসর, অবন্তিপুর, বাথিন্দা, ভুজ, বিকানের, চণ্ডীগড়, হালওয়ারা, হিন্দন, জয়সালমির, জম্মু, জামনগর, যোধপুর, কান্দলা, কাংগ্রা, কেশোদ, কিষাণগড়, কুল্লু মানালি, লেহ, লুধিয়ানা, মুন্দ্রা, নালিয়া, পাঠানকোট, পাতিয়ালা, পোরবন্দর, রাজকোট, সারসাওয়া, শিমলা, শ্রীনগর, দোইসে এবং উত্তরলাই।
এগুলো অধিকাংশই উত্তর-পশ্চিম ভারতে অবস্থিত, যেগুলোর বেশিরভাগ পাকিস্তান সীমান্তের নিকটবর্তী। কিছু বিমানবন্দর আবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এ সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের পালটা সামরিক হামলার প্রেক্ষাপট।
গত ২২ এপ্রিল ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগাম এলাকায় বন্দুকধারীদের হামলায় প্রাণ হারায় অন্তত ২৬ জন। ভারত সেই হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীকে দায়ী করে এবং গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে পাকিস্তানের ভেতরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
পাকিস্তান দাবি করে, ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তাদের ভূখণ্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এর জবাবে শুক্রবার রাতে পাকিস্তান নিজ দেশের সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে ‘অপারেশন বুনিয়ান উল মাসরুস’ চালায়।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী, এই অভিযানে ভারতের একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণাগারে হামলা চালানো হয়। তারা দাবি করেছে, অপারেশনটি ছিল ‘প্রতিরক্ষামূলক এবং উদ্দেশ্য ছিল ভারতে সামরিক মজুদের কেন্দ্রগুলোকে অকার্যকর করা’।
এই হামলা-পাল্টা হামলার পরিস্থিতিতে ভারতের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমান যোগাযোগে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া বিমানবন্দরগুলো থেকে চলাচলকারী শত শত ফ্লাইট বাতিল হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে লাখো যাত্রীর যাতায়াতে।
বিশেষ করে শ্রীনগর, অমৃতসর, জম্মু, চণ্ডীগড়, লুধিয়ানা, রাজকোট, যোধপুর, লেহসহ বেশ কয়েকটি শহর থেকে যাত্রীরা বিকল্প রুটেও ফ্লাইট না পেয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন। ভারতীয় রেলও কর্তৃপক্ষ সতর্কতার অংশ হিসেবে সীমান্তবর্তী কিছু রুটে ট্রেন চলাচল সীমিত করেছে।
এছাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া এয়ার ট্র্যাফিক সার্ভিস রুটের ফলে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলোকে বিকল্প রুটে চালাতে হচ্ছে, যার ফলে সময় ও ব্যয় উভয়ই বেড়েছে। বিশেষ করে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইটগুলোকে দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরিয়ে পাঠানো হচ্ছে।
ভারতের প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই পদক্ষেপকে ‘সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক’ বলে উল্লেখ করেছেন। ডিজিসিএ বলেছে, “মানবিক ও বেসামরিক নিরাপত্তার স্বার্থেই এ সিদ্ধান্ত। সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থা সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।”
আকাশপথ নিরাপদ না থাকলে বড় কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়। সেই বিবেচনায় বিমান চলাচল স্থগিত করে ঝুঁকি এড়াতে চাইছে ভারত।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন পর এক নতুন সামরিক উত্তেজনার সূচনা করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ এর ধারাবাহিকতায় দুই দেশই নিজেদের নিরাপত্তা প্রদর্শনের পাশাপাশি কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা প্রকাশ করছে।
তবে, এমন পদক্ষেপ দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করছে। একদিকে ভারতে বিমান ও রেল চলাচলে প্রভাব পড়ছে, অন্যদিকে পাকিস্তানে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সীমান্তের নিকটবর্তী অঞ্চলে।
জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়া ইতিমধ্যে এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং উভয় দেশকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ফের এক উত্তপ্ত সামরিক উত্তেজনার আবহ তৈরি হয়েছে। পাল্টাপাল্টি অভিযানে দুই দেশই নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করছে, যার অংশ হিসেবে ভারতে একযোগে ৩২টি বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এই অবস্থা কতদিন স্থায়ী হবে, তা নির্ভর করছে দুই দেশের কূটনৈতিক এবং সামরিক অবস্থানের ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ