
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ৭০০ বন্দির সন্ধান এখনো মেলেনি। এই বন্দিদের মধ্যে রয়েছেন ৮৪ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এবং ৯ জন জঙ্গি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন কারাগারে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। এই সময় ২,২০০ বন্দি পালিয়ে যান, যাদের মধ্যে ১,৫০০ জনকে পুনরায় গ্রেফতার করা হলেও বাকি ৭০০ জন এখনো পলাতক।
নরসিংদী জেলা কারাগারে ১৯ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় বিক্ষোভকারীরা হামলা চালিয়ে মূল গেট ভেঙে ফেলেন। এসময় ১০-১২ হাজার লোক কারাগারে প্রবেশ করে ৮২৬ বন্দিকে মুক্ত করেন, যাদের মধ্যে ৯ জন জঙ্গিও ছিলেন। পরে অস্ত্রাগার থেকে ৮৫টি অস্ত্র ও ৮,১৫০টি গুলি লুট হয়। কারাগারের বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে যায়।
কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে ৬ আগস্ট সকালে কয়েদিরা বিদ্রোহ করেন। তারা কারা অভ্যন্তরে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়ে ২০২ জন বন্দিকে পালাতে সাহায্য করেন, যাদের মধ্যে ৮৮ জন ছিলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এখনো ১৪৫ জন পলাতক রয়েছেন।
শেরপুর জেলা কারাগারে ৫ আগস্ট বিকেলে দুর্বৃত্তরা প্রধান ফটক ভেঙে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। এ সুযোগে ৫১৮ বন্দি পালিয়ে যান। পরবর্তীতে কিছু আসামি আত্মসমর্পণ করেন এবং তাদের জামালপুর জেলা কারাগারে রাখা হয়। ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জামালপুর কারাগারে থাকার পর ১২ ডিসেম্বর শেরপুর জেলা কারাগার পুনরায় চালু হলে তাদের সেখানে আনা হয়। এখনো ২৮০ জন পলাতক।
কারাগারভিত্তিক পালানো আসামি-
কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার: ২০২ জন পালায়, ৮৮ জন ছিলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত; এখনো ১৪৫ জন পলাতক।
নরসিংদী জেলা কারাগার: ৮২৬ জন পালায়, এখনো ১৪৫ জন নিখোঁজ।
সাতক্ষীরা জেলা কারাগার: ৮৭ জন পালায়, এখনো ৪৬ জন নিখোঁজ।
কুষ্টিয়া জেলা কারাগার: ৯৮ জন পালায়, ২৪ জন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি এখনো অধরা।
শেরপুর জেলা কারাগার: ৫১৮ বন্দি পালায়, এখনো ২৮০ জন নিখোঁজ।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক যারা
আল-আমিন (২৮), মুনতাসির আল জেমি (২৬), হুমায়ন কবির মোল্লা (৪৩), মো. বাহার (৪৩), শরীফুল ইসলাম নাঈম (২৬), শাহাদাত হোসেন (৪০), রাজু (৩২), রুবেল (৩৩), সবুজ মিয়া (৩৮), সবুজ মল্লিক (২৬), আবুল (৫১), ইদ্রিস মিয়া (৪০), মোয়াজ্জেম হোসেন (৩০), সোহাগ (৩০), মো. জাহাঙ্গীর হোসেন (৩৮), মো. আব্দুল মজিদ (৩৪), সাগর আহম্মে (৩১), মো. নাইম ওরফে মহিউদ্দিন নাইম (৩০), নাজমুল (৩২), মো. রুবেল মিয়া (৩৪), আসলাম বাবু (২৮), আব্দুল লতিফ (২৭), আবু মোকারম (৪৪), মো. তোফায়েল আহম্মেদ (৪০), মো. আমান উল্লাহ (২৫), মো. নজরুল ইসলাম (৪৮), মো. সাইফুল ইসলাম (৪০), তোফা মোল্লা (৩৬), ছোয়াব মিয়া (৪০), আব্দুল মালেক (৩২), আবদুল মতিন (২৯), আজিজুর রহমান পলাশ (৩৪), আমির হোসেন (৩০), নুরে আলম (৩০), মো. নাছির (৩৮), এমদাদুল হক ওরফে গন্ডার (৩০), জাহাঙ্গীর শওকত জুয়েল (৪৭), রিপন ঘোষ (৪৬), আব্দুল্লাহ শিকদার (২২), মফিজুর রহমান ওরফে মাহফুজ ওরফে মফিজ হাওলাদার (৩৭), রুবেল মন্ডল (২৭), মো. শামীম খান (২৭), মো. লিটন (৪৬), ওমর ফারুক (৩৬), মো. জানে আলম (৩৩), মো. সাইদুল ইসলাম (৩৪), মো. সবুজ (৩৪), আবুল হোসেন (৩৭), সোহাগ হাওলাদার (৩৩), মো. মনিরুল ইসলাম ওরফে রুবেল (২৮), মো. রাসেল মিয়া (২৭), মো. গোলাম নবী ওরফে আবু ওরফে রবি (২৬), মো. রুবেল (৩২), আনিসুর রহমান (৩৩), মো. সায়েদ ফকির ওরফে সায়েদ ওরফে সাইফুল (২৭), বাদল মিয়া (৩০), মো. এবাদুর রহমান ওরফে পুতুল (৪৪), হৃদয় ওরফে মানিক (২৮), ইসলাম মীর (৪৩), মো. সোহেল রানা (৩২), রিপন (৩৬), মো. ফিরোজ হোসেন (২৩), মো. নুর আলম মিয়া (২৭), ভাংগন মন্ডল (৩০), মো. শাহ আলম (৪০), মো. বাহাদুর মিয়া (৩৫), আমিনুল হক (৩৯), এছাহাক ওরফে সুমন হাওলাদার (৪২), মো. রাব্বী হোসেন ওরফে মনা (৩০), সোহেল (২৮), মো. সুমন জোমাদ্দার (২৭), লুকিমুদ্দিন ওরফে লোকমান (৫৪), শাহিন মল্লিক (৩৩), সাকিব ওরফে বাবু (২২), বিডিআর সদস্য সিপাহী মো. আমিনুল ইসলাম (৪০), বিডিআর সদস্য সিপাহী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম (৩৬), বিডিআর সদস্য সিপাহী মো. ইব্রাহিম (৪১), বিডিআর সদস্য সিগন্যালম্যান মো. মনির হোসেন (৪২) এবং মজনু (৩৪)।
অস্ত্র লুট ও অগ্নিসংযোগ
বিশেষত নরসিংদী জেলা কারাগারে ৮২৬ বন্দি পালিয়ে যান। এদের মধ্যে অনেকে ছিলেন জঙ্গি। হামলাকারীরা কারা অভ্যন্তরে লকার ভেঙে অস্ত্রাগার থেকে ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৮,১৫০ রাউন্ড গুলি লুট করে। একইভাবে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকেও অন্তত ৯ জঙ্গি পালিয়ে যায়, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উচ্চঝুঁকির অপরাধী হিসেবে পরিচিত।
কারা সূত্র জানায়, এসব অস্ত্র উদ্ধার না হলে তা চরমপন্থী গোষ্ঠী ও সন্ত্রাসীদের হাতে গিয়ে নতুন করে সহিংসতা সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এখন পর্যন্ত ৯৪টি অস্ত্র লুটের মধ্যে মাত্র ৬৫টি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) সূত্র জানায়, পলাতক ৭০০ বন্দির তালিকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন শাখায় দেওয়া হয়েছে। পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি এই তালিকা অনুযায়ী গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালাচ্ছে।
সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন ও মিডিয়া) মো. জান্নাত উল ফরহাদ বলেন, ইতোমধ্যে ১,৫০০ বন্দিকে গ্রেফতার করে কারাগারে আনা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন জানান, দেশের ৬৯টি কারাগারের মধ্যে ১৭টি কারাগার পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ। এসব কারাগার দ্রুত সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে উন্নত নজরদারির জন্য কারাগারগুলিতে প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, জেল থেকে পালানো ৭০০ বন্দিকে এতদিনেও গ্রেফতার করা যায়নি, তার অর্থ হচ্ছে তাদের শক্তিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শীর্ষ পর্যায়ের আসামিরা পলাতক থাকা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা প্রশ্নে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হলে কারাগারে বন্দি রাখা কঠিন হবে। অথবা যে কোনো সময় বিদ্রোহ করে কারাগার ভেঙে পালিয়ে যাওয়ার উদাহরণ তৈরি হতে পারে। এ ধরনের উদাহরণ সমাজে তৈরি হলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও জঙ্গি হওয়ায় দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেফতারে অভিযান চালালেও এখনো ৭০০ জন পলাতক রয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি দেশের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ