
ছবি: সংগৃহীত
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে শুরু হওয়া সশস্ত্র সংঘাত এখন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সাধারণ মানুষের জীবনকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ভারতশাসিত কাশ্মীর ও পাকিস্তানশাসিত আজাদ কাশ্মীর—দুই অংশেই দিন কাটছে আতঙ্ক আর বোমার শব্দে। একের পর এক গোলা আছড়ে পড়ছে ঘরবাড়ির পাশে, মাঠে, রাস্তায়। বহু গ্রাম কার্যত জনশূন্য হয়ে পড়েছে। যারা পারেন, তারা গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে আশ্রয়ের সন্ধানে দৌড়েছেন। কেউ কেউ আশ্রয় নিচ্ছেন পুরনো সুরঙ্গ বা সিমেন্টের তৈরি শৌচাগারেও।
বিশ্ব গণমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, সাম্প্রতিক হামলার পাল্টাপাল্টি অভিযানে সীমান্তঘেঁষা গ্রামগুলোতে বহু বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। গুলিবর্ষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মানুষজন এখন নিজের বাড়িতেও আর নিরাপদ বোধ করছেন না।
উরিতে মসজিদের বেসমেন্টে রাত, কুপওয়ারায় গ্রামে প্রথমবার গোলা
ভারতশাসিত কাশ্মীরের কুপওয়ারা জেলার ক্রালপোরা গ্রামের বাসিন্দা তনভির আহমেদ জানান, তার জীবনে এই প্রথমবার নিজ গ্রামের ভেতরেই গোলা পড়ে গেল। শুক্রবার ভোরে তার বাড়ির সামনে একটি শক্তিশালী গোলা পড়ে, যার অভিঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় তার ট্রাক ও একটি মাটি কাটার যন্ত্র। ভাগ্যক্রমে, হামলার কিছু সময় আগেই তার পরিবার ৫০০ মিটার দূরে একটি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গিয়েছিল। তবে তাদের গ্রামে এখনও পর্যন্ত কোনো প্রতিরক্ষামূলক বাংকার তৈরি হয়নি।
উরির বাসিন্দা নিসার হুসেইন বলেন, “রাতে গোলার শব্দে আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠি। এক পুরনো মসজিদের বেসমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নিই। সকালে বাড়ি ফিরে দেখি, বাড়ির একপাশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।” তিনি জানান, সেই বেসমেন্টটি তৈরি হয়েছিল প্রায় এক দশক আগে, স্থানীয় লোকজনের চাঁদায়।
পুঞ্চে নারী ও শিশুদের কান্না, হাঁটতে হাঁটতে পালানোর গল্প
কাশ্মীরের আরেক সীমান্তবর্তী এলাকা পুঞ্চ জেলার সুরানকোট। সেখানে গিয়ে বিবিসি-র আরেক প্রতিবেদক ডেভিনা গুপ্তা জানতে পারেন, বুধবার রাতের ভারতীয় হামলার পর থেকে পাকিস্তান পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু করেছে এবং তা এতটাই তীব্র যে গ্রামের পর গ্রাম মানুষ ফাঁকা করে দিচ্ছে।
সোবিয়া নামের এক নারী তার এক মাস বয়সী শিশুকে কোলে নিয়ে রাতের আঁধারে দৌড়ে পালিয়েছেন। “রাস্তায় একটা গাড়িও ছিল না। আমি হেঁটে অনেক দূর গিয়েছি। পুরো পথটায় আমি ভয়ে কাঁদছি,” বলছিলেন তিনি। একই গ্রামে সুরফিন আখতারের বাড়ির সামনে গোলা পড়ে যাওয়ার পর সেও আর দেরি না করে পরিবার নিয়ে পালান।
পাকিস্তান সীমান্তেও আতঙ্কের রাত, ২০০৫ সালের পরেও এমন ভয়াবহতা দেখেননি স্থানীয়রা
পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের চাকোঠি গ্রামের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সেখানকার বাসিন্দা কিফায়াত হুসেইন বলছিলেন, “এই প্রজন্ম এমন গোলাবর্ষণ কখনও দেখেনি। ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সময় এ রকম হয়েছিল, তখন ওরা তো জন্মায়নি।” তিনি জানান, গোলাবর্ষণের পুরো রাত তার পরিবার একটি কংক্রিটের শৌচাগারে বসে কাটিয়েছে।
২০০৫ সালের ভূমিকম্পের পর চাকোঠিসহ আজাদ কাশ্মীরের অনেক বাড়িতে টিনের ছাদ বসানো হয়েছিল। কিন্তু এইসব ছাদ কোনোভাবেই গোলার আঘাত প্রতিরোধ করতে পারে না। কিফায়াত বলেন, “একটার পর একটা বিস্ফোরণে সব বাসনপত্র পড়ে যায়, আর বাচ্চারা কেঁদে ওঠে।”
নীলম উপত্যকা ছেড়ে পালাচ্ছেন পরিবারসহ স্থানীয়রা
পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের নীলম উপত্যকায়ও একই চিত্র। গোলা পড়ে গেছে বহু ঘরের সামনে, কোথাও কোথাও ছিন্নভিন্ন হয়েছে ঘরবাড়ি। সেখানকার বাসিন্দা মুহাম্মদ শাগির পরিবারকে নিয়ে চলে এসেছেন রাজধানী মুজাফ্ফরাবাদে। তিনি বলেন, “আমার বাড়ির সামনেই একটা ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়ে। তখনই সিদ্ধান্ত নিই, আর থাকা যাবে না। ছোট ছোট বাচ্চারা আতঙ্কে কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। পরদিন সকালেই আমি ওদের নিয়ে বোনের বাড়ি চলে যাই।”
সংঘাতের পেছনে কী?
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই সাম্প্রতিক উত্তেজনার সূত্রপাত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এরপর ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এর জবাবে পাকিস্তান ‘অপারেশন বুনিয়ান উল মারসুস’ শুরু করে, যার লক্ষ্য ছিল ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণাগারগুলো।
উভয় দেশের পক্ষ থেকে সামরিক হামলা চালানোর ফলে নিয়ন্ত্রণরেখা ঘেঁষা অসংখ্য গ্রাম ও শহরে গোলা পড়ছে, বাড়ছে হতাহত। তবে এর সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ, যারা কোনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থেকেও প্রতিদিন আতঙ্ক আর মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছেন।
এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে সীমান্তবাসী
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষজন ভয়, উদ্বেগ এবং চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। স্থানীয় প্রশাসনগুলো আশ্রয়কেন্দ্র চালু করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। পানি, খাদ্য, ওষুধ—এইসব জরুরি সরবরাহও চরমভাবে সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে।
যুদ্ধ কি সীমান্ত পেরিয়ে আরও বিস্তৃত হবে? নাকি কূটনীতিক কোনো সমাধানে পৌঁছবে দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ? সীমান্তের দুই পাশে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষের জন্য আপাতত এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ