ছবি: সংগৃহীত
কোরআনুল কারিম মানবজাতির জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এক পবিত্র গ্রন্থ, যা পৃথিবী ও পরকাল নিয়ে পূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে। কোরআনের মৌলিক উদ্দেশ্য হলো মানুষের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালনা করা, যাতে তারা পরকালীন শান্তি ও সফলতা অর্জন করতে পারে। কোরআনের এই মৌলিক বিষয়গুলি মানবজীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রকে আচ্ছাদিত করে, তবে এর মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের পরকালের মুক্তি নিশ্চিত করা।
ইমাম শাতেবি (রহ.) তার মহান গ্রন্থ "আল-মুওয়াফাকাত"-এ কোরআনের তিন মৌলিক বিষয় চিহ্নিত করেছেন। এই বিষয়গুলি কোরআনের সার্বিক উদ্দেশ্য এবং তার প্রভাবশালী শিক্ষাগুলির মূল ভিত্তি। নিচে এই তিনটি মৌলিক বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১. আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পরিচয়
কোরআনের প্রথম মৌলিক বিষয় হলো আল্লাহ তাআলার পবিত্র সত্তা এবং তাঁর গুণাবলি। আল্লাহর নাম, তাঁর কর্ম এবং তাঁর বান্দাদের প্রতি দয়ার অনুকূলতা বর্ণনা করা কোরআনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। কোরআন বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর অজস্র নাম ও গুণাবলি তুলে ধরে, যাতে মানুষ আল্লাহকে যথাযথভাবে জানতে পারে এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য গড়ে তুলতে পারে। এর মধ্যে নবুওয়ত বা প্রেরিত রাসূলদের ব্যাপারে আলোচনা করা হয়, কারণ নবুওয়ত আল্লাহ এবং তাঁর বান্দাদের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে।
২. আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পদ্ধতিসমূহ
দ্বিতীয় মৌলিক বিষয়টি হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পদ্ধতিগুলি, যা কোরআনে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এই বিষয়ে ইবাদত, সামাজিক সম্পর্ক, লেনদেন, অধিকার, কর্তব্য, এবং সকল ধরণের আচরণ এবং শিষ্টাচারের উপর আল্লাহর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোরআনে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রাসঙ্গিক আইন ও নীতিমালা বিধান করা হয়েছে, যাতে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে এবং তার নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করতে পারে। এই বিধানগুলো সমাজে শান্তি, সৌহার্দ্য এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য।
৩. মানুষের শেষ পরিণতি
কোরআনের তৃতীয় মৌলিক বিষয় হলো মানুষের শেষ পরিণতি, অর্থাৎ মৃত্যুর পর মানুষ কীভাবে পরকালীন জীবনে উত্তীর্ণ হবে। কোরআনে মৃত্যু, কিয়ামত, জান্নাত এবং জাহান্নামের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এই তৃতীয় বিষয়টি মানুষের অন্তরে ঈমান শক্তিশালী করে এবং তাকে পরকালের প্রস্তুতি নিতে প্রেরণা দেয়। কিয়ামতের দিন, জান্নাতের সৌভাগ্য এবং জাহান্নামের শাস্তি সম্পর্কে নানা আয়াত রয়েছে, যা মানুষের সঠিক পথে চলার জন্য উৎসাহিত করে এবং অসৎ কর্ম থেকে বিরত রাখে। কোরআন এই পরিণতি বর্ণনা করে মানুষকে শাস্তির ভয় ও পুরস্কারের আশ্বাস দেয়।
কোরআনুল কারিমের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সেই পথ প্রদর্শন করা, যার মাধ্যমে তারা পৃথিবীতে এমনভাবে জীবনযাপন করবে, যা তাদের পরকালীন মুক্তি ও সফলতা নিশ্চিত করবে। কোরআন আমাদের শেখায় যে, এ পৃথিবী একটি পরীক্ষা কেন্দ্র, এবং সফলতা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে নিহিত। মানুষকে তার কর্মের প্রতি সতর্কতা এবং পরকালের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে উৎসাহিত করা হয়। কোরআনের শিক্ষাগুলি শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের জন্যও প্রযোজ্য।
কোরআন আমাদের শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং মানব সমাজের সকল স্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর নির্দেশনা প্রদান করে। সামাজিক সুষ্ঠুতা, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, মানুষের অধিকার রক্ষা, এবং মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার জন্য কোরআন অবিচলিত দিকনির্দেশনা প্রদান করে। সমাজে দয়া, সদাচার, সহযোগিতা, এবং মানবিক মূল্যবোধ রক্ষার ক্ষেত্রে কোরআনের নির্দেশনা অপরিহার্য।
আমরা আজকাল অনেক সময় কোরআনুল কারিমকে আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন বা ইতিহাসের আলোকে বিচার করতে চেষ্টারত দেখি। এই ধরনের প্রচেষ্টা কিছুটা উপকারি হতে পারে, তবে এটি কোরআনের মূল উদ্দেশ্য থেকে মানুষের মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারে। কোরআন প্রকৃতপক্ষে পৃথিবী ও প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করে, তবে তার লক্ষ্য কেবল আল্লাহর শক্তি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা প্রদর্শন করা, এবং মানুষকে তার সৃষ্টির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে তার অন্তরের বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করা।
কোরআনের তিন মৌলিক বিষয়—আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পরিচয়, তাঁর সন্তুষ্টি লাভের পদ্ধতি, এবং মানুষের শেষ পরিণতি—একত্রে মানুষকে একটি সঠিক জীবনদর্শন প্রদান করে। এই মৌলিক বিষয়গুলো আমাদের শিখায় কিভাবে একটি সফল, নৈতিক এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকারী জীবন কাটানো যায়। কোরআন শুধু একজন মুসলিমের ব্যক্তিগত জীবনকে নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য শান্তি, সৌহার্দ্য, এবং ন্যায়ের ভিত্তি স্থাপন করে।
এমনকি যখন মানুষ কোরআন অধ্যয়ন করে, তখন তার দৃষ্টি সঠিকভাবে কোরআনের মূল উদ্দেশ্য ও উদ্দেশ্যভিত্তিক শিক্ষার দিকে থাকা উচিত, যাতে সে পরকালীন মুক্তির পথপ্রদর্শক আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সফল হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



