
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বিনোদন জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে ওটিটি বা ওভার দ্য টপ প্ল্যাটফর্মের উত্থান। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি বাড়ছে এর সংখ্যা ও প্রভাব। হাতে মোবাইল কিংবা ঘরে বসেই দর্শকরা এখন নাটক, সিরিজ কিংবা সিনেমা উপভোগ করতে পারছেন। এ সুযোগ তৈরি করেছে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার, যা প্রযুক্তিনির্ভর এ যুগে বিনোদনের ধারাটিকে আমূল বদলে দিয়েছে। তবে এই পরিবর্তনের মধ্যেও এক শ্রেণির শিল্পী ও নির্মাতারা রয়েছেন মারাত্মক অনিশ্চয়তার মধ্যে—তারা হলেন মূলত ঢাকাই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পী ও নির্মাতারা, যাদের অস্তিত্ব এই নতুন প্ল্যাটফর্ম সংস্কৃতিতে প্রায় বিলীন হওয়ার পথে।
ওটিটির কারণে কাজের পরিধি বেড়েছে—এটি যেমন সত্য, তেমনি এটিও সত্য যে, এই সুযোগ খুব সীমিত পরিসরে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওটিটির জন্য যেসব কনটেন্ট নির্মিত হচ্ছে, সেগুলোর অধিকাংশেই কাজ করছেন নাটক ইন্ডাস্ট্রির পরিচিত মুখ এবং বিজ্ঞাপন জগতের নির্মাতারা। অর্থাৎ, যারা আগে থেকেই টেলিভিশন মিডিয়ায় সক্রিয় ছিলেন, তারাই এই নতুন মাধ্যমেও আধিপত্য বিস্তার করছেন। বিপরীতে, সিনেমা শিল্পীরা—যারা এফডিসিকেন্দ্রিক ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন—তারা ওটিটির এই জোয়ারে একপ্রকার উপেক্ষিত। ফলে তারা যেমন কাজ পাচ্ছেন না, তেমনি এই সময়োপযোগী বিনোদন মাধ্যমের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে না পারার কারণে হচ্ছেন পেছনে পড়া একটি শ্রেণিতে পরিণত।
বাংলাদেশে বর্তমানে সক্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘চরকি’, ‘বঙ্গ বিডি’, ‘বিঞ্জ’, ‘বায়োস্কোপ’, ‘সিনেম্যাটিক’, ‘আই স্ক্রিন’, ‘দীপ্ত প্লে’, ‘বাংলাফ্লিক্স’, ‘টফি’, ‘টেলিফ্লিক্স’, ‘সিনেস্পট’ ইত্যাদি। এর বাইরেও রয়েছে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম যেমন ‘নেটফ্লিক্স’, ‘অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও’, ‘হইচই’, ‘আড্ডা টাইমস’, ‘ডিজনি প্লাস হটস্টার’সহ আরও কিছু। এসব মাধ্যমে মুক্তি পাওয়া কনটেন্টের তালিকায় রয়েছে ‘তাকদীর’, ‘মহানগর’, ‘গুটি’, ‘আমি কী তুমি’, ‘ফ্রাইডে’, ‘কুহেলিকা’, ‘নিকষ’, ‘মোবারকনামা’, ‘বুকের মধ্যে আগুন’, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’, ‘জিম্মি’, ‘ছায়া’, ‘হাউ সুইট’, ‘গোলাম মামুন’, ‘চক্র’, ‘কালপুরুষ’সহ অনেক আলোচিত সিরিজ ও সিনেমা। তবে সবার মাঝেই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়—এগুলোতে কাজ করেছেন মূলত নাটকের শিল্পীরা। সিনেমার পরিচিত মুখ এখানে প্রায় অনুপস্থিত।
এই পরিস্থিতি সিনেমাপাড়ায় ব্যাপক হতাশা তৈরি করেছে। নব্বই দশকের শেষভাগ থেকে যে ধ্বস নেমেছিল ঢাকাই চলচ্চিত্রে, তা আজ আরও গভীর হয়েছে। একসময় যেখানে বছরে শতাধিক সিনেমা মুক্তি পেত, এখন তা এসে ঠেকেছে হাতে গোনা কিছু সংখ্যায়। বিশেষ করে ঈদ ছাড়া বছরের অন্য সময়গুলোতে উল্লেখযোগ্য কোনো সিনেমা নির্মাণ হয় না বললেই চলে। এমন অবস্থায় পুরোনো সিনিয়র শিল্পীরা হয়ে পড়ছেন বেকার, আর তরুণরাও আগ্রহ হারাচ্ছেন এই পেশায় আসতে।
এই সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে ওটিটিতে সিনেমার শিল্পীদের স্থান না থাকায়। অনেক নির্মাতা বলছেন, সিনেমার তারকাদের একজনের পারিশ্রমিক দিয়ে একটি ওয়েব সিরিজের কয়েকটি পর্ব নির্মাণ সম্ভব হয়। অন্যদিকে কেউ কেউ মনে করেন, এফডিসিকেন্দ্রিক অনেক শিল্পী ও নির্মাতাই এখনো ওটিটিকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেননি। তাদের মতে, ওটিটি একটি ‘গুরুত্বহীন’ প্ল্যাটফর্ম, যা কখনোই সিনেমার সমান হতে পারে না। এমন মানসিকতা নিয়ে যারা বসে আছেন, তারা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় নিজেদের আরও পিছিয়ে ফেলছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচালক বলেন, “সিনেমার অনেক শিল্পী ওটিটি কনটেন্টের ভাষা, বিষয়বস্তু এবং উপস্থাপন শৈলীর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। তারা এখনও পুরোনো ফর্মুলা নিয়ে পড়ে আছেন, যা বর্তমান দর্শকের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। এ কারণে নির্মাতারাও তাদেরকে কাস্ট করতে আগ্রহ দেখান না।”
অপরদিকে, অনেক নাট্যনির্মাতা এবং ওয়েব কনটেন্ট নির্মাতা ওটিটিকে একটি আশীর্বাদ বলেই মনে করছেন। কারণ তারা এ মাধ্যমে স্বাধীনভাবে গল্প বলতে পারছেন, সেন্সরশিপের বাধা ছাড়াই। ফলে একাধিক নতুন নির্মাতা ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর ওটিটিতে উঠে এসেছেন, যাদের কেউ কেউ দেশের বাইরেও আন্তর্জাতিক দর্শক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এতে করে বাংলাদেশের কনটেন্ট এক্সপোর্টেরও একটি নতুন বাজার তৈরি হচ্ছে।
তবে ওটিটি প্রসঙ্গে সবাই একমত নন। অনেকের মতে, ওটিটির অবাধ প্রবাহ নাটক এবং নাটকের ঐতিহ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশেষ করে ইউটিউবে মুক্তি পাওয়া অনেক নিম্নমানের কনটেন্ট শুধু ভিউ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়, যার কারণে নাটকের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। যদিও পেইড সাবস্ক্রিপশন ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মগুলোতে কিছু ভালো কনটেন্ট নির্মিত হচ্ছে, সেখানেও দেখা যাচ্ছে নাটক শিল্পীদেরই আধিক্য।
এই পরিস্থিতিতে সিনেমার শিল্পীদের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে—সময় ও মাধ্যমের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। নয়তো ওটিটির এই জোয়ারে তারা শুধু উপেক্ষিতই নয়, ভবিষ্যতে হয়তো পুরোপুরিই হারিয়ে যাবেন বাংলা বিনোদনজগতের পাতা থেকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ