
ছবি: সংগৃহীত
সত্তরের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সময়টিতে চিত্রটা ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। তখন কলকাতার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছিল একপ্রকার অস্তিত্ব সংকটে, আর বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ছিল রমরমা অবস্থায়। সেই সময় কলকাতার বহু শিল্পী পেটের দায়ে পাড়ি জমাতেন ঢাকার দিকে। কারণ সেখানে কাজের সুযোগ ছিল বেশি, ছিল দর্শকপ্রিয়তার নিশ্চয়তা। ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে অনেকেই নিজেদের ক্যারিয়ার বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তখনকার বাংলাদেশি সিনেমা ছিল এক শক্তিশালী বাজার, যা কলকাতার তারকাদের আকৃষ্ট করতো।
তবে সময় বদলেছে। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে সেই গতি উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে ভাটা পড়তে থাকে। দর্শক হারাতে শুরু করে সিনেমা হলগুলো, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব দেখা দেয়, বন্ধ হয়ে যায় একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ। আর এদিকে কলকাতার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ‘টলিউড’ নতুন জোয়ারে পা রাখে। আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন, আন্তর্জাতিক নির্মাণমান এবং তরুণ পরিচালকদের হাত ধরে টলিউড এগিয়ে যেতে থাকে। ফলে ঢাকাই তারকারা ওপারের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে কলকাতাও সংকটে পড়েছে—বিশেষ করে কোভিড-পরবর্তী সময়ে আর্থিক সংকট ও প্রেক্ষাগৃহ দর্শক সংকটের কারণে টলিউডও এখন স্থবির অবস্থায়। তবু একে অপরের বিপরীতে না থেকে এখন শিল্পীরা সুযোগমতো দুই দিকেই দৌঁড়াচ্ছেন।
গত দুই বছর ধরে ঢাকাই চলচ্চিত্র শিল্প নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। একের পর এক নতুন ছবি নির্মাণ হচ্ছে, যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রেও তৈরি হচ্ছে নতুন রূপরেখা। এই পুনর্জাগরণ পর্বে কলকাতার শিল্পীদেরও আগমন ঘটেছে। এর মধ্যে আছেন ইধিকা পাল, মিমি চক্রবর্তী, নুসরাত জাহান, কৌশানী মুখার্জী, সায়ন্তিকা, দর্শনা বণিক প্রমুখ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সফলভাবে বাংলাদেশের দর্শক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন, আবার অনেকে এসেছেন কেবল ক্যারিয়ার রক্ষা করতে, কারণ কলকাতার ইন্ডাস্ট্রিতে তারা এখন উপেক্ষিত।
অন্যদিকে বাংলাদেশি অনেক শিল্পীও কলকাতায় পাড়ি জমিয়ে সেখানকার দর্শকদের মাতিয়ে তুলেছেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন জয়া আহসান, রাফিয়াত রশীদ মিথিলা, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, অপূর্ব, তাসনিয়া ফারিণ প্রমুখ। তারা শুধু অভিনয়েই নয়, ওপারের পুরস্কার ও স্বীকৃতিতেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এমনকি বাংলাদেশি শিল্পীদের কলকাতায় কাজ করা এখন অনেকের কাছেই গর্বের বিষয়।
তবে সম্প্রতি বিষয়টি একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। কিছু বাংলাদেশি তারকা, যারা পূর্বে কলকাতায় sporadic কাজ করেছেন, তারা এখন স্থায়ীভাবে সেখানেই থাকতে চাইছেন। মূলত বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদলের পর এসব শিল্পীর পেশাগত চাহিদা, গ্রহণযোগ্যতা ও সামাজিক অবস্থানে প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে যারা অতীতে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন, তারা এখন শিল্পাঙ্গনে চরম কোণঠাসা। তারা কাজ পাচ্ছেন না, মিডিয়াতে উপেক্ষিত। ফলে তারা কলকাতাকেই ভবিষ্যতের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন।
এ তালিকায় রয়েছে কয়েকজন নামকরা তারকা। চিত্রনায়ক আরিফিন শুভ হচ্ছেন তাদের একজন। তিনি ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমায় বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করে আলোচনায় আসেন। মাত্র এক টাকা পারিশ্রমিকে কাজ করায় তাকে তৎকালীন সরকারী পর্যায়ে পুরস্কৃতও করা হয়। এমনকি শেখ হাসিনা তাকে পূর্বাচলে একটি প্লট উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু এই আওয়ামীপন্থী অবস্থানই বর্তমানে তার ক্যারিয়ারের বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে তিনি একপ্রকার আড়ালেই আছেন। মিডিয়াতে তাকে দেখা যায় না, কোনো কাজও হাতে নেই।
সম্প্রতি জানা যায়, আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতায় গোপনে গিয়ে সৌমিক সেন পরিচালিত একটি ওয়েব সিরিজ ‘জ্যাজ সিটি’র শুটিং করেছেন। কলকাতার এক সংবাদ মাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি স্থায়ীভাবে সেখানেই থেকে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানান। নিজের অবস্থানকে ‘অরাজনৈতিক’ দাবি করে শুভ বলেন, “আমি শুধু অভিনয় জানি, কোনো ব্যবসা নেই, ব্যাকআপ নেই। সত্যিই যদি সমস্যায় পড়তাম, তাহলে কলকাতায় বসে এই সাক্ষাৎকার দিতে পারতাম না।” বর্তমানে তার একাধিক সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় থাকলেও দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে।
একইভাবে অভিনেত্রী ও আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ কর্মী সোহানা সাবা আছেন বিপাকে। তিনি আগে দলের হয়ে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন এবং ‘আলো আসবেই’ নামে সমালোচিত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সদস্য ছিলেন। এ গ্রুপের মূল উদ্দেশ্য ছিল ছাত্র আন্দোলন দমন, যার পরিকল্পনায় গরম পানি ছুড়ে মারার মত ভয়াবহ পদক্ষেপও ছিল বলে অভিযোগ। তার বিরুদ্ধেও বর্তমানে হত্যা চেষ্টার মামলা চলছে। তবে তিনি এখনো সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয়, এবং কলকাতায় কাজ ও স্থায়ী আবাসের স্বপ্নে বিভোর। সম্প্রতি গণমাধ্যমে তিনি জানান, “আমি কলকাতার সিনেমার অন্ধ ভক্ত। সুযোগ পেলে সেখানে কাজ করতেই ভালোবাসবো।”
আরেকজন আলোচিত নাম নুসরাত ফারিয়া। শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করে যিনি অনেক প্রশংসিত ও বিতর্কিত হন। তবে ছাত্র আন্দোলনের সময় দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যান এবং সামাজিক মাধ্যমে উত্তাপ ছড়ান তার খোলামেলা ছবি দিয়ে। দেশে ফিরেও ছিলেন নিভৃতে। যদিও তার অভিনীত সিনেমা মুক্তি পেয়েছে ঈদুল ফিতরে, কিন্তু সমালোচনার কারণে সেগুলো তেমন দর্শক টানতে পারেনি। ফলে তাকেও আর কাজ দিচ্ছেন না অনেক প্রযোজক ও নির্মাতা। ফলে তার নজর এখন কলকাতার দিকেই। এক সাক্ষাৎকারে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “দেশের নির্মাতারা আমাকে ব্যবহার করতে পারেননি। কলকাতার নির্মাতারা অনেক বেশি পেশাদার।”
এইসব শিল্পীদের কলকাতায় স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা আসলে শুধুই পেশাগত দিক বিবেচনায় নয়—বরং এটি একটি রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের রক্ষার জন্য, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার জন্য কলকাতাকেই ভবিষ্যতের ‘সেফ হ্যাভেন’ ভাবছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ