
ছবি: সংগৃহীত
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোতে নজিরবিহীন শূন্যতা তৈরি হয়েছে। একসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মন্ত্রণালয় ও ছয়টি দপ্তর সচিবশূন্য থাকায় প্রশাসনিক কার্যক্রমে বড় ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এসব দপ্তরে রুটিন দায়িত্বে রয়েছেন অতিরিক্ত সচিবরা, যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ ক্ষমতা না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত ও প্রশাসনিক ফাইল ঝুলে থাকছে দিনের পর দিন। ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গতি কমে গেছে।
বিগত বছরের ৬ নভেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সাঈদ মাহবুব বেলাল হায়দারকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। এরপর ২০ নভেম্বর সেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদকে। কিন্তু এই বদলির মাত্র এক মাস নয় দিন পর, অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর তাকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে নতুনভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলস্বরূপ, মন্ত্রণালয়টি আবার সচিবশূন্য হয়ে পড়ে এবং তখন থেকেই (ছয় মাস পার হলেও) এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ সচিব নিযুক্ত হয়নি। বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন কেবল রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন।
এই বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “চেয়ারম্যানের কাজ যেমন মেম্বার দিয়ে হয় না, তেমনি সচিবের কাজও অতিরিক্ত সচিব দিয়ে সম্ভব নয়। গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত ফাইল ও প্রকল্প অনুমোদনের সিদ্ধান্তগুলো কেবল সচিব পর্যায়েই নেওয়া যায়। কিন্তু সচিব না থাকায় অনেক কিছু ঝুলে আছে।”
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলামকে গত ২৫ মার্চ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। তারপর থেকে এই বিভাগে নতুন সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এখানেও অতিরিক্ত সচিব মো. ইসমাইল হোসেন কেবলমাত্র রুটিন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, সমবায় কার্যক্রমের তদারকি ও নীতিগত নির্দেশনার জন্য সচিব পর্যায়ের নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩০ এপ্রিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব ড. মো. মুশফিকুর রহমান অবসরে গেলে এই বিভাগটিও সচিবশূন্য হয়ে পড়ে। এখনও পর্যন্ত নতুন সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে বর্তমান অতিরিক্ত সচিব মো. জহিরুল ইসলাম সেখানে সীমিত ক্ষমতায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই বিভাগটির এক কর্মকর্তা বলেন, “ডাক ও টেলিযোগাযোগ খাত এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু সচিব না থাকায় আমরা অনেক সিদ্ধান্ত সময়মতো নিতে পারছি না। ফলে কর্মপরিকল্পনায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।”
মাত্র ১৯ জুন এক প্রজ্ঞাপনে সরকার একযোগে চার সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে। তারা হলেন: কাজী এনামুল হাসান – বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক (সচিব), সুকেশ কুমার সরকার – জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক (সচিব), মুহম্মদ ইবরাহিম – ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব) এবং মো. সহিদ উল্যাহ – জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমির রেক্টর (সচিব)।
এই হঠাৎ সিদ্ধান্তের ফলে একযোগে চারটি দপ্তর সচিবশূন্য হয়ে পড়ে, যা প্রশাসনিক কার্যক্রমে বিরাট ধাক্কা দিয়েছে। এ ছাড়া ২৪ জুন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব খোরশেদা ইয়াসমীনকে অবসরোত্তর ছুটিতে পাঠিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে দুদকেও এখন সচিব নেই।
বর্তমানে সচিবশূন্য অবস্থায় থাকা ৯টি দপ্তর ও মন্ত্রণালয় হলো: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় সংসদ সচিবালয়, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড, জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমি, ভূমি আপিল বোর্ড এবং জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমি (নাডা)
এই সব জায়গায় সচিব পদে না থাকায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে প্রকল্প অনুমোদন, বাজেট ব্যবস্থাপনা, আন্তর্জাতিক সমন্বয় ও মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্বগুলো ব্যাহত হচ্ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সচিব পদে নিয়োগ, বদলি ও পদায়নের দায়িত্বে থাকলেও এই দীর্ঘসূত্রতা প্রশ্ন তুলেছে মন্ত্রণালয়ের দক্ষতা ও পরিকল্পনা ঘাটতি নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সচিব পর্যায়ে দ্রুত নিয়োগ না হওয়া সরকারের প্রশাসনিক সক্ষমতা ও জবাবদিহিতাকে দুর্বল করে।
প্রশাসনিক বিশ্লেষকদের মতে, "বর্তমানে বাংলাদেশ যে ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—অর্থনৈতিক চাপ, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা—তার জন্য সুদৃঢ় بيرোক্রেটিক কাঠামো অপরিহার্য। কিন্তু সচিব পদে শূন্যতা সেই কাঠামোয় বড় ফাটল তৈরি করছে।"
সচিবশূন্য এসব দপ্তরের কর্মকর্তারা এবং সংশ্লিষ্ট মহল থেকে জোরালোভাবে দাবি উঠেছে, দ্রুত পূর্ণ সচিব নিয়োগ দিয়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে হবে। বিশেষ করে যেসব দপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে সচিব নেই, সেখানে শূন্যতা পূরণ না হলে জাতীয় পর্যায়ের কার্যক্রমে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটতে পারে।
সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, “একটি দপ্তরের প্রশাসনিক প্রাণ হচ্ছে সচিব। যেহেতু তিনি নীতিনির্ধারক ও বাস্তবায়নের মূল ব্যক্তি, তাই সচিব ছাড়া দপ্তরের কার্যকারিতা এক রকম অচল অবস্থায় পড়ে। সরকারকে দ্রুত এই সংকট সমাধান করতে হবে।”
বর্তমানে সচিবশূন্যতার সংকট বাংলাদেশের সরকারি প্রশাসনে এক গভীর ও দুশ্চিন্তাজনক বাস্তবতা। এটি শুধু প্রশাসনের গতি কমিয়ে দিচ্ছে না, বরং জাতীয় উন্নয়ন, নীতিনির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের ভাবমূর্তিও প্রভাবিত হচ্ছে। এ অবস্থায় শিগগিরই পূর্ণ সচিব নিয়োগ দিয়ে সরকারকে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে করে নীতিগত অচলাবস্থা দূর হয় এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রাণ ফিরে আসে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ