
ছবি: সংগৃহীত
রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে। শুক্রবার (৯ মে) বিকেল থেকে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী ছাত্রশিবির, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলনসহ একাধিক দলের নেতাকর্মীরা। তাদের মূল দাবি—আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে সরকারিভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। তা না হওয়া পর্যন্ত তারা শাহবাগ ছাড়বেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
বিকাল পৌনে পাঁচটা থেকে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে স্লোগানে স্লোগানে মুখর করে তোলেন এলাকাটি। আন্দোলনকারীরা দলে দলে ভাগ হয়ে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। স্লোগানগুলো ছিলো—‘আওয়ামী লীগের ঠিকানা এই বাংলায় হবে না’, ‘এই মুহূর্তে ব্যান চাই’, ‘আবু সাইদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘জুলাইয়ের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’ ইত্যাদি।
শাহবাগ চত্বরে থাকা বিজ্ঞাপন বোর্ডের নিচে অবস্থান নেন এনসিপি নেতাকর্মীরা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, যিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরব না। শাহবাগেই আওয়ামী লীগের কবর খুঁড়ব। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেরি করলে সারা বাংলা ব্লকডেড দেব।” তিনি আরও বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশের প্রস্তুতি নিতে হবে।”
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন এক পর্যায়ে বলেন, “আমরা এখানে কোনো দলীয় পরিচয় নিয়ে আসিনি, আমরা সাধারণ জনতা হয়ে এসেছি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে।”
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি আজিজুল হক ইসলামাবাদী সরাসরি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, “আওয়ামী লীগকে বাংলার জমিনে রাজনীতি করতে দেওয়া যাবে না। অবিলম্বে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।”
এছাড়া মাঠে উপস্থিত ছিলেন মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানী ও তার অনুসারীরাও, যাদের অনেককেই পোস্টার হাতে দেখা যায়—যেখানে লেখা ছিলো, ‘বাংলাদেশ উইদাউট আওয়ামী লীগ’ চাই।
এর আগে বিকালে রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের পার্শ্ববর্তী সড়কে একটি গণসমাবেশ হয়, যা আয়োজন করে এনসিপি। দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ সেখানে বক্তব্য দিয়ে বলেন, “বাংলাদেশের অগ্রগতি শুরু হবে সেদিন, যেদিন বাংলাদেশ পাবে একটি নতুন পরিচয়—‘বাংলাদেশ উইদাউট আওয়ামী লীগ’। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো আমাদের আওয়াজ শুনতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই আমরা সড়কে নেমেছি। আজ এখান থেকে আমরা শাহবাগ অবরোধ করব।”
শাহবাগ অবরোধের আগে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই এনসিপির নেতাকর্মীরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন 'যমুনা’র সামনে অবস্থান নিতে শুরু করেন। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত তারা সেখানেই অবস্থান করেন এবং শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেন। তাদের দাবি ছিল, "৫ আগস্টের ঘটনার পর এতদিনেও আওয়ামী লীগকে কেন নিষিদ্ধ করা হলো না?"
এ আন্দোলনে আরও সক্রিয় ছিলেন 'জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ' মাহমুদুর রহমান খান সোহেলের স্ত্রী মরিয়ম খানম। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা আমাদের প্রাণের দাবি। ৫ আগস্টের পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও এখনো কেন প্রজ্ঞাপন হয়নি? সরকার আমাদের বাধ্য করেছে মাঠে নামতে।”
এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত শাহবাগ মোড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন দিকে ব্যারিকেড দিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন এবং গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন। এখনও কোনো পক্ষই আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়নি।
এখন পর্যন্ত পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের তেমন কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা চোখে পড়েনি। তবে শাহবাগ ও এর আশপাশের এলাকায় অতিরিক্ত নিরাপত্তা সদস্য মোতায়েনের প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো কোনো মন্তব্য আসেনি। তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই অবরোধ সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করবে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি শুধু একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের বিষয় নয়, এটি সরাসরি দেশের সংবিধান, বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং নিরাপত্তার প্রশ্নে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
এই প্রতিবাদ কতটা বিস্তৃত হবে, এবং সরকার ও অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষ কীভাবে এই দাবির প্রতিক্রিয়ায় পদক্ষেপ নেবে—তা এখন দেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ