
ছবি: সংগৃহীত
ছত্তিশগড়-তেলেঙ্গানা সীমান্তে ঐতিহাসিক অভিযান চালিয়ে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী ৩১ জন মাওবাদী বিদ্রোহীকে হত্যা করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই অভিযানে সেনাদের “অভূতপূর্ব সাহসিকতা ও কৌশলী পরিকল্পনা”র প্রশংসা করে একে ‘নকশালবাদের বিরুদ্ধে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অভিযান’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু হওয়া এই অভিযানে অংশ নেয় ভারতের প্রায় ২৬ হাজার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। অভিযানের মূল এলাকা ছিল কারেগুত্তালু পাহাড়, যা ছত্তিশগড় ও তেলেঙ্গানার সীমান্তে অবস্থিত। পাহাড়টি দীর্ঘদিন ধরে নকশাল তথা মাওবাদী বিদ্রোহীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত ছিল।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই দীর্ঘ অভিযানে এখন পর্যন্ত ২১৪টি বিদ্রোহী আস্তানা ও বাঙ্কার ধ্বংস করা হয়েছে, উদ্ধার করা হয়েছে শত শত বিস্ফোরক দ্রব্য। অভিযান চলাকালীন পুরো এলাকায় বিমান নজরদারি, ড্রোন ব্যবহার এবং আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় বিদ্রোহীদের কার্যকলাপ মনিটর করা হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ১৪ মে বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এ দেওয়া এক পোস্টে জানান, “মধ্য ভারতের ছত্তিশগড় এবং তেলেঙ্গানার সীমান্তে ২১ দিনব্যাপী এই যৌথ অভিযানে মাওবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বড় ধরনের আঘাত হানা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “নিরাপত্তা বাহিনী এই অভিযানে অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে কাজ করেছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই পুরো অভিযানে আমাদের একজনও জওয়ান হতাহত হননি। এটা এক ঐতিহাসিক সাফল্য।”
ভারতে নকশালবাদী বা মাওবাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটে ১৯৬৭ সালে, পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি অঞ্চল থেকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র এবং তেলেঙ্গানার অভ্যন্তরীণ এলাকায়। এদের অবস্থান ছিল মূলত আদিবাসী ও বনাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকায়, যেখানে এই গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘদিন ধরে “উপজাতিদের ভূমি, বন ও জীবনধারার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম” চালিয়ে আসছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কারেগুত্তালু পাহাড়ের গভীরে বহু বছর ধরে মাওবাদীদের সম্মিলিত প্রশিক্ষণ ঘাঁটি, অস্ত্রাগার এবং যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। এখান থেকেই বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র হামলা ও গেরিলা কার্যক্রম চালানো হতো।
২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে মাওবাদী গেরিলাদের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১৫-২০ হাজার, যার মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশকে ইতোমধ্যে নিষ্ক্রিয় করেছে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী। তবে পাহাড়ি জঙ্গল, দুর্গম ভূখণ্ড এবং স্থানীয় আদিবাসীদের সমর্থন পাওয়ায় এই গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
বর্তমান বিজেপি সরকারের আমলে মাওবাদী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতির আওতায় টেকসই ও সামগ্রিক কৌশল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক অভিযানের মাধ্যমে এই নীতির বাস্তব প্রয়োগ আরও একবার প্রতিফলিত হয়েছে।
অমিত শাহ আরও জানান, “কারেগুত্তালু পাহাড়ে মাওবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রশিক্ষণ এবং কৌশলগত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। এবার তাদের সেই শক্ত ঘাঁটিতেই হানা দিয়ে সফলভাবে পুরো পরিকাঠামো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।”
যদিও ভারত সরকার এই অভিযানকে 'অসাধারণ সাফল্য' হিসেবে তুলে ধরেছে, তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো একে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আল জাজিরা উল্লেখ করেছে, বহু নকশাল সংগঠন আদিবাসীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছে, যেখানে সরকার বারবার দমনমূলক কৌশল নিয়েছে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, শুধুমাত্র সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। বরং সরকারের উচিত হবে আদিবাসীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জমির মালিকানা এবং জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে কার্যকর নীতি প্রণয়ন।
ভারতের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বড় এই বিরোধী দমন অভিযানে ৩১ জন বিদ্রোহীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মাওবাদী আন্দোলনের একটি শক্ত ঘাঁটির অবসান ঘটলো। তবে এটি শুধুমাত্র সামরিক সাফল্য হিসেবে নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গভীর আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে।
এই অভিযান একদিকে যেমন ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল, অন্যদিকে তেমনি এটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনের ওপর কী প্রভাব ফেলবে—তা নির্ধারণ করবে পরবর্তী সরকারি নীতিমালা এবং সংলাপের ধরন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ