
প্রতীকী ছবি
এক বছর বন্ধ থাকার পর পুনরায় উন্মুক্ত হলো বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এবার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে মালয়েশিয়ায় কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রথম দফায় যাচ্ছেন ৭ হাজার ৯২৬ জন শ্রমিক। এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মালয়েশিয়ায় সফররত প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল।
তিনি বৃহস্পতিবার (১৬ মে) মালয়েশিয়া থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ভিডিও বার্তায় এসব তথ্য জানান। মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সরকারের অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি এই বার্তা দেন।
প্রসঙ্গত, গত এক বছর ধরে নানা জটিলতার কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য কার্যত বন্ধ ছিল। ২০২৩ সালের শেষ দিকে যারা মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও শেষ মুহূর্তে যেতে পারেননি, তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৭ হাজার। এদের অনেকেই নির্দিষ্ট কোম্পানি থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত হওয়ার পরও বিভিন্ন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এবং কোটা জটিলতার কারণে যেতে পারেননি।
২০২৩ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বাংলাদেশ সফরে এসে এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার আশ্বাস দেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সখ্যতার কারণে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অনুরোধে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
এই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতেই মালয়েশিয়া সরকার প্রথম পর্যায়ে ৭ হাজার ৯২৬ জন বাংলাদেশি শ্রমিকের একটি তালিকা চূড়ান্ত করেছে। এদের মধ্য থেকে খুব শিগগিরই শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছেন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, “মালয়েশিয়ার তিনজন মন্ত্রীর সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা ব্যাচ ওয়াইজ করে এসব শ্রমিক নেবেন। প্রথম ব্যাচ হিসেবে ৭৯২৬ জনের তালিকা ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত হয়েছে।”
তবে শুধু এই সংখ্যাতেই সীমাবদ্ধ নয়। মালয়েশিয়া সরকার আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এক থেকে দেড় লাখ বিদেশি শ্রমিক নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি মিলেছে। মালয়েশিয়ার অন্তর্বর্তী মানবসম্পদমন্ত্রী উপদেষ্টা নজরুলকে আশ্বস্ত করেছেন, “বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি লোক নেয়া হবে। বাংলাদেশকে শীর্ষ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।”
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনায় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করেছেন। তার অন্যতম ছিল বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্ত করার আহ্বান। তিনি বলেন, “আমরা অনুরোধ করেছি যেন বাংলাদেশে যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে, তাদের সবার জন্য সমান সুযোগ রাখা হয়, যেন তারা শ্রমিক পাঠাতে পারে। মালয়েশিয়া সরকার বলেছে, তারা বিষয়টি বিবেচনায় রাখবে এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত জানাবে।”
এছাড়াও তিনি অনিয়মিত বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়মিতকরণের প্রস্তাবও দেন। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যেসব শ্রমিকদের ভিসা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে, তাদের ক্ষেত্রে নিয়মিতকরণ সম্ভব নয়; তবে মালিকপক্ষের ত্রুটির কারণে যদি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাহলে তা পৃথকভাবে বিবেচনা করা হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হলো মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসার প্রস্তাব। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি শ্রমিকরা শুধু সিঙ্গেল এন্ট্রি ভিসা পান, ফলে পরিবার দেখা বা জরুরি প্রয়োজনে দেশে আসা-যাওয়া কঠিন হয়। অন্যদিকে, অনেক দেশের শ্রমিকরা মাল্টিপল এন্ট্রি সুবিধা পান। এ বিষয়ে উপদেষ্টা মালয়েশিয়ার মন্ত্রীদের অনুরোধ করেন এবং তারা দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন।
আসিফ নজরুল আরও বলেন, “আমি এখানে বলেছি যে সিকিউরিটি গার্ড, কেয়ারগিভার, নার্সসহ বিভিন্ন পেশায় দক্ষ শ্রমিক নেওয়া যায় কি না। তারা এ বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন এবং আলোচনা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছেন।”
উপদেষ্টা জানান, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ব্যক্তিগতভাবেও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে গভীরভাবে মনোযোগী। তিনি নিজেই দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন, বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন এবং পুরো প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য তদারকি করছেন।
এই লক্ষ্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল মঙ্গলবার (১৪ মে) মালয়েশিয়া সফরে যায়। সফরের শুরুতেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য ইতিবাচক অগ্রগতি নিশ্চিত করা হয়েছে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনরায় উন্মুক্ত হওয়া বাংলাদেশের অভিবাসন খাতের জন্য একটি বড় সফলতা। প্রথম দফার ৭৯২৬ জন শ্রমিকের রপ্তানির মধ্য দিয়ে নতুন একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেল। তবে এই সুযোগকে আরও সম্প্রসারণ করতে হলে নিয়মিত যোগাযোগ, দক্ষ জনবল প্রস্তুত এবং স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকেও দায়িত্বশীলভাবে ভূমিকা রাখতে হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ