ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ এখন এক নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। দীর্ঘ ১৬ বছরের একক দলীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশে চলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া। এই রূপান্তরের নেতৃত্বে রয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও মাইক্রোক্রেডিটের পথিকৃৎ ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি একসময় রাজনৈতিকভাবে বিতাড়িত হলেও এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর প্রক্রিয়ায়।
২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগকে অনেকে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের’ নাম করে একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অভিযুক্ত করতেন। ড. ইউনূস সম্প্রতি ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “গত ১৬ বছর ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক ভূমিকম্পের সময়। গণতন্ত্র ছিল কাগজে, বাস্তবে নয়।” তার ভাষ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার শাসনকাল ছিল একটি আধা-স্বৈরতান্ত্রিক সময়, যেখানে বাকস্বাধীনতা, বিচারব্যবস্থা ও নির্বাচনী পদ্ধতি ছিল ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাধীন।
২০২৪ সালের আগস্টে ব্যাপক গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার পতন ঘটে। এরপরেই গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, “আমরা ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে নতুন ভিত্তি গড়ছি। এখন আমরা সঠিক পথে হাঁটছি। জনগণ আমাদের পাশে আছে।”
শেখ হাসিনার পতনের পর সামনে আসে তার শাসনামলের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় গণমাধ্যমের তদন্তে উঠে এসেছে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হতো, যা দেশের অর্থনীতিতে এক ভয়াবহ ক্ষতির ছাপ রেখে গেছে। এর পাশাপাশি বিরোধী নেতা, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও ছাত্রদের গুম, খুন ও নিপীড়নের অভিযোগে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চলছে। যদিও তিনি এসব অভিযোগ ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দাবি করে অস্বীকার করেছেন।
ক্ষমতায় আসার পরপরই ড. ইউনূস শুরু করেন ব্যাপক রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংবিধানিক সংস্কার। ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কমিশন:
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন
সংবিধান পুনর্লিখন কমিশন
এছাড়া সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে দেশের ৩৫টিরও বেশি রাজনৈতিক দল, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, গবেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। এই কমিশনের মূল উদ্দেশ্য একটি সর্বসম্মত রাজনৈতিক চুক্তি ও সংস্কারপন্থী রূপরেখা তৈরি করা, যা ‘জুলাই সনদ’ নামে পরিচিত হবে।
এখন পর্যন্ত কমিশনটি ১৬৬টি সুপারিশ গ্রহণ করেছে। এ সুপারিশগুলো নির্বাচন, প্রশাসন, পুলিশি সংস্কার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং সংখ্যালঘু অধিকার সংক্রান্ত। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ জানিয়েছেন, “এই প্রথমবার আমরা বিচার বিভাগে স্বাধীনতার কিছু নমুনা দেখতে পাচ্ছি। বিচারপতিদের নিয়োগের পদ্ধতিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমেছে।”
তিনি আরও জানান, “আমরা আশা করছি জুলাইয়ের মধ্যে ‘জুলাই সনদ’ সম্পূর্ণ হবে এবং আগস্ট নাগাদ এটি বাস্তবায়নের রূপরেখা গৃহীত হবে।”
তবে সংস্কারের এ যাত্রা নিরবিচারে সমর্থন পাচ্ছে না। কিছু প্রস্তাব সামাজিক ও ধর্মীয় মহলে উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। যেমন:
নারী অধিকার কমিশন উত্তরাধিকার আইনে নারীদের সমান অংশের সুপারিশ করেছে, যা ইসলামপন্থী দল ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে।
শিক্ষা ও পোশাক শিল্প নিয়ে কাজের জন্য পৃথক কমিশন চাওয়া হলেও এখনো তা গঠন হয়নি। দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পকে উপেক্ষা করা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে কিছু মহলে।
এই সব বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভবিষ্যতে বিষয়ভিত্তিক উপকমিশন গঠনের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।
ড. ইউনূস স্পষ্ট করেছেন, তিনি ভবিষ্যৎ কোনো নির্বাচনে অংশ নেবেন না। “আমি একটি সেতুবন্ধন তৈরি করতে চাই—ক্ষমতার জন্য লড়াই নয়।” তার ভাষ্যে স্পষ্ট, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যেই একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় আগামী ডিসেম্বরেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যদি রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এখনো শান্ত নয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়নি বলেই মনে করছেন অধিকাংশ মানুষ। একটি জরিপ অনুযায়ী, ৬০ শতাংশ নাগরিক মনে করছেন ‘পুলিশ-রাজনীতি সম্পর্ক’ এখনো অনিয়ন্ত্রিত। বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও ধর্মঘট এখনো নিয়মিত ঘটনা।
আওয়ামী লীগের নিবন্ধন ইতোমধ্যে ১২ মে বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। ফলে দলটি এখন আর কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। দলটির নেতা মোহাম্মদ আরাফাত বলেন, “আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু ষড়যন্ত্র ও জঙ্গি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আমাদের সরানো হয়েছে। আমরা রাজপথে থেকেই লড়াই চালিয়ে যাব।”
আওয়ামী লীগ এখন রাজনীতির মূলধারার বাইরে থাকলেও, তাদের কিছু এলাকায় সাংগঠনিক প্রভাব এখনো রয়েছে।
বর্তমান সরকার ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরেছে, ব্যাংক খাতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ এনেছে, তবে অর্থনৈতিক গতি এখনো মন্থর। রেমিটেন্স কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু বিনিয়োগে আস্থা ফিরিয়ে আনতে এখনো সময় লাগছে। অনেকেই বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া অর্থনীতির পূর্ণ পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে। ১৬ বছরের একনায়কতান্ত্রিক ও দলকেন্দ্রিক শাসনের পরে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে দেশে গঠিত হয়েছে একটি জাতীয় ঐকমত্যের সংস্কারমুখী সরকার। ইতিবাচক উদ্যোগ, বিতর্ক, ও রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ ভবিষ্যতের পথে হাঁটছে—যেখানে রয়েছে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা, সামাজিক সমতার প্রত্যাশা এবং এক নতুন রাজনৈতিক ভারসাম্য গঠনের আশা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



