
ছবি: সংগৃহীত
চলমান মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বহু প্রতীক্ষিত মহার্ঘ ভাতা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা জোরালো হয়ে উঠেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের একাধিক বৈঠকে বিষয়টি ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে এবং এবার সম্ভবত দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটেই এই ভাতা চালুর ঘোষণা আসতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
চলতি বছর জানুয়ারির শুরুতে সরকারি কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা চালুর বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল ভাতার হার ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণের জন্য। তবে তীব্র অর্থনৈতিক চাপ, রাজস্ব ঘাটতি এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর শর্তপূরণের চাপে সেই সময় ভাতা কার্যকরের উদ্যোগটি স্থগিত রাখা হয়।
কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রশাসনের ভেতরে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটেই নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টি ফের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছেন। সূত্র জানায়, এবার বাজেট ঘোষণার আগেই ভাতা চালুর প্রস্তাব চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং আগামী ২০ মে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
এই বৈঠকে প্রাথমিকভাবে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত মহার্ঘ ভাতা প্রদানের একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। অর্থ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভাতার বিষয়টি চূড়ান্ত হলে সেটি প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনক্রমে আসন্ন বাজেট বক্তৃতায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বাজেটে মহার্ঘ ভাতা সংক্রান্ত আলাদা অনুচ্ছেদও যুক্ত করা হতে পারে।
বর্তমানে আলোচনায় থাকা প্রস্তাব অনুযায়ী, কর্মচারীদের ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রেডভিত্তিক বিভাজন আনার চিন্তাভাবনা চলছে। প্রাথমিকভাবে ভাবা হচ্ছে:
১ থেকে ৯ম গ্রেডের কর্মীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা: ১০ শতাংশ
১০ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা: ২০ শতাংশ
তবে বিকল্প একটি প্রস্তাবও রয়েছে, যেখানে ১-৯ গ্রেডের ভাতা ১৫ শতাংশ নির্ধারণের কথা ভাবা হচ্ছে। এই হারে ভাতা কার্যকর হলে মোট অতিরিক্ত ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যেখানে ১০ শতাংশ হারে ভাতা চালু হলে ব্যয় হবে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
বর্তমান অর্থবছরের মূল বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ ছিল ৮২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত সরকারের সময়ে বেতন-বৈষম্য নিরসনের নামে ধারাবাহিক পদোন্নতির ফলে সংশোধিত বাজেটে এই খাতের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকা।
নীতিনির্ধারকদের মতে, আগে থেকেই বেতন কাঠামোর তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন ও মধ্যম পর্যায়ের সরকারি চাকরিজীবীরা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছেন। বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, ভাড়া, শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে। মহার্ঘ ভাতা চালু না করায় কর্মকর্তাদের মধ্যে যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, সেটিকে আর উপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেসুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, “এখনই এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে অর্থ উপদেষ্টার নেতৃত্বে আসন্ন বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হবে, যেখানে তিনি জনপ্রশাসন সংক্রান্ত কমিটির প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করবেন।”
গত জানুয়ারিতে যখন মহার্ঘ ভাতার আলোচনা শুরু হয়েছিল, তখন দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে অর্থনীতিবিদরা সেই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিলেন। বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণের চাপ, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভ সংকট এবং কর আদায়ের দুর্বলতার পটভূমিতে এই সিদ্ধান্তকে ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যয়’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন অনেকে। ফলে সরকার তখন পিছিয়ে গেলেও এখন পরিস্থিতি বদলেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, “একদিকে কর্মচারীদের মধ্যে চাপ বাড়ছে, অন্যদিকে বাজেট সামনে। ফলে এই মুহূর্তে মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা দিলে তা একটি ইতিবাচক বার্তা দেবে এবং প্রশাসনের ভেতরের অসন্তোষও অনেকটা প্রশমিত হবে।”
সব কিছু ঠিক থাকলে এবং প্রধান উপদেষ্টার সম্মতি মিললে, জুলাই থেকে মহার্ঘ ভাতা কার্যকর হতে পারে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হতে পারে।
এই ভাতা চালু হলে একদিকে যেমন সরকারি চাকরিজীবীদের ব্যয়ভার কিছুটা লাঘব হবে, তেমনি সরকারের উপর আর্থিক চাপও বাড়বে। তবে দীর্ঘদিন পর মহার্ঘ ভাতা চালু হলে এটি একটি ইতিবাচক সামাজিক বার্তা হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাচ্ছে, সরকার এখন আর বিষয়টি নিয়ে বিলম্ব করতে চাচ্ছে না। কর্মচারীদের মনোবল বাড়ানো এবং প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থেই জুলাই থেকে মহার্ঘ ভাতা কার্যকরের ঘোষণা আসা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বাংলাবার্তা/এমএইচ