
ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। এই দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের একটি রাজনৈতিক সমাধান বের করার লক্ষ্যে বহু প্রচেষ্টা চলেছে, কিন্তু কোনো পক্ষই এখনো পর্যন্ত কার্যকর ও স্থায়ী শান্তির পথে আগাতে পারেনি। সম্প্রতি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে আয়োজিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠককে ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে কিছুটা আশার সঞ্চার হলেও, শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতির কারণে সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছে দুই দেশের প্রেসিডেন্টদের অবস্থান।
ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন না। রাশিয়ার এ সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, পুতিন আলোচনায় না থাকলে তার পক্ষে সেখানে উপস্থিত থাকা অর্থহীন। সুতরাং জেলেনস্কিও আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন না। ফলে বহুল প্রতীক্ষিত শীর্ষ বৈঠকটি দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে, যা সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমঝোতার পথকে জটিল করে তুলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
পুতিনের অনুপস্থিতিকে 'অসম্মানজনক' বললেন জেলেনস্কি
ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, রুশ প্রেসিডেন্টের এই অনুপস্থিতি শুধু তার দেশের প্রতি নয়, বরং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং আলোচনায় সহায়তা করতে ইচ্ছুক অন্যান্য মধ্যস্থতাকারীদের প্রতিও এক ধরনের অবজ্ঞা। জেলেনস্কি অভিযোগ করেন, রাশিয়ার দিক থেকে শান্তি স্থাপনের কোনো আন্তরিক উদ্যোগ নেই বলেই পুতিন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন।
তিনি আরও বলেন, "এটি শুধু আমাদের যুদ্ধ নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ইস্যু। আমাদের ভূখণ্ড দখল হয়ে আছে, জনগণ মারা যাচ্ছে, লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সর্বোচ্চ নেতৃত্বের অনুপস্থিতি শুধু দুঃখজনক নয়, এটি বিপজ্জনকও।"
মার্কিন অবস্থান ও ট্রাম্পের মন্তব্য
এই বৈঠক নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। তিনি মন্তব্য করেছেন, "আমার সঙ্গে পুতিনের বৈঠক না হওয়া পর্যন্ত এই আলোচনা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম।"
ট্রাম্পের এই মন্তব্যকে অনেকে মার্কিন নির্বাচনী রাজনীতির অংশ হিসেবে দেখছেন। তবে তার ইঙ্গিতটা ছিল পরিষ্কার—রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এখনো এমন একটি পর্যায়ে রয়েছে, যা এই যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বর্তমান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইস্তাম্বুল বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলকে। তবে তিনি আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, আলোচনার ফল নিয়ে তিনি খুব বেশি আশাবাদী নন।
যুক্তরাজ্যের সতর্ক বার্তা
এদিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার মন্তব্য করেছেন, "শান্তির পথ এড়িয়ে যাওয়া পুতিনের জন্য এক সময় বড় মাশুলে পরিণত হবে। যদি এই আলোচনা ব্যর্থ হয়, তাহলে তার দায় সরাসরি রাশিয়ার ওপরই বর্তাবে।"
তুরস্কের মধ্যস্থতা এবং বৈঠকের কাঠামো
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, এই বৈঠকে রাশিয়া, ইউক্রেন এবং তুরস্কের মধ্যে একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হবে। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন এবং তুরস্কের মধ্যে আরেকটি ত্রিপাক্ষিক আলোচনাও অনুষ্ঠিত হবে।
তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরেই এই যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতার চেষ্টা করে আসছে। বিশেষ করে ২০২২ সালের শুরুর দিকে কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলে শস্য রপ্তানির বিষয়ে যে চুক্তি হয়, তা ছিল তুরস্ক ও জাতিসংঘের সক্রিয় প্রচেষ্টার ফল। তবে বর্তমান আলোচনায় রাজনৈতিক সমঝোতা অর্জনের পথ কতটা মসৃণ হবে, তা নিয়ে এখনই সংশয় দেখা দিয়েছে।
আলোচনায় রাশিয়ার প্রস্তুতি ও আশাবাদ
রুশ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ভ্লাদিমির মেডিনস্কি জানিয়েছেন, আলোচনার জন্য প্রস্তুত রাশিয়া এবং স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় রুশ প্রতিনিধি দল উপস্থিত থাকবে। তিনি বলেন, ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকার ব্যাপারে তারা আশাবাদী এবং আগের যেকোনো পূর্বশর্ত বাদ দিয়ে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে একটি গঠনমূলক দিক খোঁজার চেষ্টা করবেন।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও বর্তমান অবস্থা
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ ইতোমধ্যে ইউরোপের ভূরাজনীতিতে এক বিশাল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, লক্ষাধিক মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে এবং ইউক্রেনের বিশাল একটি অংশ এখনো রুশ সেনাবাহিনীর দখলে রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন একটি সময়ে দুই পক্ষের শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতিতে আলোচনা শুরু হওয়া যথেষ্ট উদ্বেগজনক। কারণ, উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এই যুদ্ধ থামানো সম্ভব নয়। এবং সেই সদিচ্ছার সবচেয়ে বড় প্রতীক হতে পারতেন দুই দেশের প্রেসিডেন্টরাই।
ইস্তাম্বুল বৈঠককে ঘিরে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে যতটুকু আশা ছিল, বাস্তবতা ততটা সহানুভূতিশীল নয়। পুতিন ও জেলেনস্কির অনুপস্থিতিতে আলোচনার গুরুত্ব কিছুটা কমে গেলেও, নিচু পর্যায়ের কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে অন্তত একটি সংলাপের পরিবেশ তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন কিছু বিশ্লেষক।
তবে এটি যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বড় কোনো মোড় এনে দেবে—এমন প্রত্যাশা এখনই করা যাচ্ছে না। আলোচনা সফল হবে কি না, তা নির্ভর করছে ভবিষ্যতের কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে, রয়টার্স, আল জাজিরা, এএফপি
বাংলাবার্তা/এমএইচ