
ছবি: সংগৃহীত
চীন ফের ভারতের অরুণাচল প্রদেশের বিভিন্ন স্থানের নাম পরিবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা নিয়ে নয়াদিল্লি আবারও কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই পদক্ষেপকে ‘বাস্তবতা বদলানোর অর্থহীন চেষ্টা’ হিসেবে অভিহিত করে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারতের বক্তব্য অনুযায়ী, “অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, আছে এবং থাকবে।” চীনের পক্ষ থেকে বারবার নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে অঞ্চলটির উপর দাবি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভূখণ্ডগত বাস্তবতা পাল্টাতে পারবে না বলে জানিয়েছে ভারত।
পঞ্চমবারের মতো চীনের ‘নামকরণ উদ্যোগ’
রোববার (১১ মে), চীনের বেসামরিক বিষয়ক মন্ত্রণালয় অরুণাচল প্রদেশের জন্য নতুন একটি তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে ২৭টি নতুন ভূ-নামের উল্লেখ রয়েছে। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বিভিন্ন পাহাড়, নদী, হ্রদ, গিরিপথ ও আবাসিক এলাকা। প্রতিটি নাম দেওয়া হয়েছে চীনা ভাষায়, তিব্বতি অনুবাদে এবং ‘পিনইন’-এ, যার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে নির্দিষ্ট জিও-কোঅর্ডিনেট ও উচ্চ রেজুলেশনের মানচিত্র।
চীনের দাবি অনুযায়ী, এটি তাদের ‘ভূ-নাম নীতির আওতায় একটি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ’, যা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অংশ। চীনের মতে, তারা যে অঞ্চলকে “জাংনান” বলে অভিহিত করে—তাই প্রকৃতপক্ষে চীনের ভূখণ্ড, এবং সেখানকার নামকরণ বা পুনঃনামকরণ তাদের স্বাভাবিক প্রশাসনিক অধিকার।
ভারতের জবাব: “নাম বদলালে ভূখণ্ড বদলায় না”
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বুধবার (১৪ মে) স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “চীনের এমন ‘সৃজনশীল নামকরণ’ কোনোভাবেই ভূখণ্ডগত বাস্তবতা পরিবর্তন করতে পারে না। অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এই সত্য চীনের এ ধরনের হাস্যকর উদ্যোগে বদলাবে না।” তিনি আরও বলেন, “ভারত এই উদ্যোগকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করছে।”
চীনের পাল্টা প্রতিক্রিয়া
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান এক বিবৃতিতে বলেন, “জাংনান হচ্ছে চীনের অংশ। তাই সেখানকার কিছু স্থানের নাম সংশোধন বা হালনাগাদ করা চীনের অভ্যন্তরীণ অধিকার। এতে অন্য কোনো দেশের আপত্তির যুক্তিসঙ্গততা নেই।”
চীনের এই ভূ-নাম প্রচেষ্টা নতুন নয়। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত চীন মোট পাঁচ দফায় অরুণাচলের বিভিন্ন অঞ্চলের নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথমবার ২০১৭ সালে ৬টি, এরপর ২০২১ সালে আরও ৬টি, ২০২৩ সালে ১১টি, ২০২৫ সালের মার্চে ৩০টি এবং সর্বশেষ এবার মে মাসে ২৭টি নাম ঘোষণা করল।
সম্পর্ক উন্নতির ইঙ্গিতের মধ্যেই উত্তেজনা
এ ধরনের পদক্ষেপ এমন এক সময় এলো, যখন ভারত ও চীনের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিত মিলছিল। পূর্ব লাদাখে ২০২০ সালের জুনে গালওয়ান উপত্যকায় প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর দুই দেশের মধ্যে চার বছরের সামরিক অচলাবস্থা চলছিল। তবে গত বছর উভয় পক্ষের মধ্যকার কয়েক দফার কূটনৈতিক ও সামরিক আলোচনার ফলে কিছু উত্তেজনা প্রশমিত হয় এবং সীমান্ত অঞ্চল থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ঠিক সেই মুহূর্তে চীনের এই নতুন নামকরণ ভারত-চীন সম্পর্ককে আবারও নতুন করে চাপের মুখে ফেলতে পারে। দিল্লি মনে করছে, এই নামকরণ এক প্রকারের মানসিক আগ্রাসন এবং কূটনৈতিক চাপ তৈরির কৌশল, যার মাধ্যমে চীন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘সীমান্ত বিতর্ক’কে জিইয়ে রাখতে চায়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
যদিও আন্তর্জাতিক মঞ্চে অধিকাংশ দেশ অরুণাচল প্রদেশকে ভারতের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তবে চীনের কৌশলগত দাবিগুলো ক্রমশ আঞ্চলিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কৌশলগত মহলে বিষয়টি গভীর নজরদারিতে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অরুণাচল ইস্যু শুধু দুই দেশের মধ্যকার সীমান্ত বিরোধ নয়; এটি বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার খেলা, যেখানে চীন তাদের দখলদার মানসিকতার বার্তা দিতে চায়, আর ভারত তার সার্বভৌম সীমারক্ষায় দৃঢ় অবস্থানে থাকতে চায়।
চীনের এমন ধারাবাহিক নাম পরিবর্তনের প্রক্রিয়া অরুণাচল প্রদেশকে ঘিরে চলমান ভূ-রাজনৈতিক বিরোধকে আরও জটিল করে তুলছে। ভারত যদিও কূটনৈতিকভাবে কড়া প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, তবু এই মানসিক যুদ্ধ কতদূর গড়াবে, তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে এখন পর্যন্ত ভারতের অবস্থান স্পষ্ট: “নাম পাল্টালে সীমান্ত পাল্টায় না।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ