
ছবি: সংগৃহীত
যুদ্ধবিরতির আবরণে ঢাকা থাকলেও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরিতা ও আস্থাহীনতার বাতাবরণ একটুও হালকা হয়নি—তারই সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ঘটলো ১৪ মে, মঙ্গলবার। দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবার একে অপরের হাইকমিশনের একজন করে কূটনীতিককে 'অবাঞ্ছিত ব্যক্তি' (persona non grata) হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজ নিজ দেশ ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে। একদিনের ব্যবধানে এই পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে এবং বিশ্লেষকদের ধারণা, এটি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে আরও কঠিন ও উত্তপ্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
ইসলামাবাদে ভারতীয় কূটনীতিক বহিষ্কার
মঙ্গলবার দুপুরে এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তাকে তার মর্যাদার পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’ ঘোষণা করা হয়েছে। তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় চার্জ দ্য’অ্যাফেয়ার্সকে পররাষ্ট্র দপ্তরে ডেকে এনে এ সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় এবং তার মাধ্যমে ভারত সরকারকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়।
পাক পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ওই ভারতীয় কর্মকর্তার কর্মকাণ্ড কূটনৈতিক আদর্শ ও ভিয়েনা কনভেনশনের পরিপন্থী ছিল, যা একজন কূটনীতিকের জন্য অনুচিত। যদিও বিবৃতিতে নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি ঠিক কী ধরনের কর্মকাণ্ডে তিনি লিপ্ত ছিলেন, তবে পাকিস্তানি প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, এটি কোনো গুপ্তচরবৃত্তি কিংবা রাজনৈতিক সংবেদনশীল স্থানে অনধিকার প্রবেশ সংক্রান্ত হতে পারে।
নয়াদিল্লিতে পাকিস্তানি কূটনীতিক বহিষ্কার
এই ঘটনার ঠিক আগে, ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত পাকিস্তান হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, ওই কর্মকর্তা এমন কিছু কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছেন যা তার কূটনৈতিক মর্যাদার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তবে এখানেও অভিযোগের বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানি কূটনীতিকের বিরুদ্ধে অভিযোগও একই ধরনের—কোনো গোপন তথ্য সংগ্রহ, অগ্রহণযোগ্য সংযোগ রক্ষা, অথবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কার্যকলাপে অংশগ্রহণ। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সম্ভবত নজরদারির মাধ্যমে এসব কর্মকাণ্ডের প্রমাণ সংগ্রহ করে এবং তারপর তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়।
কূটনৈতিক অচলাবস্থা ও ভবিষ্যৎ আশঙ্কা
উল্লেখ্য, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি কার্যকর থাকলেও সীমান্তে অনিয়মিত গুলিবিনিময়, কাশ্মীর ইস্যু, সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ ও জলবন্টন সংকটসহ একাধিক ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্ক প্রতিনিয়তই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে থাকে। সর্বশেষ এই কূটনীতিক বহিষ্কারের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ সম্পর্কের ওপর এক নতুন চাপ সৃষ্টি করলো।
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক নীতিমালায় ‘persona non grata’ ঘোষণা সাধারণত তখনই করা হয়, যখন কোনো বিদেশি কূটনীতিকের আচরণ স্বাগতিক দেশের নিরাপত্তা, সংবেদনশীলতা বা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে এই ধরনের পদক্ষেপ সাধারণত শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার পথ সংকুচিত করে দেয়। বিশেষ করে এমন একটি সময়ে, যখন দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি।
পারস্পরিক আস্থার চরম সংকট
এই বহিষ্কারের ঘটনার মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার সংকট আবারও প্রকাশিত হলো। দুই দেশের কূটনৈতিক মহলে এখন উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে, আর উভয় রাষ্ট্রের গণমাধ্যমে চলছে দোষারোপ ও প্রতিক্রিয়ামূলক প্রচারণা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় অবিলম্বে দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক সংলাপ শুরু হওয়া জরুরি। নয়তো, এই টানাপোড়েন আরও তীব্র হয়ে সীমান্ত পরিস্থিতিকেও উত্তপ্ত করে তুলতে পারে, যার পরিণতি হতে পারে আবারও সহিংসতা কিংবা যুদ্ধের আশঙ্কা।
এখন দেখার বিষয়—এই পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক লড়াই দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ককে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়। বিশ্ববাসী একটাই প্রত্যাশা করে—ভারত ও পাকিস্তান বিবাদ নয়, বরং বোঝাপড়ার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দিকেই এগিয়ে যাবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ