
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের এক প্রধান উদ্বেগের নাম মূল্যস্ফীতি। খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামছাড়া দামের কারণে সাধারণ মানুষ যখন দিশেহারা, তখন কিছুটা স্বস্তির বার্তা দিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, আগামী বছরের মে মাস নাগাদ দেশে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে। এমনকি চলতি বছরের মধ্যেই তা ৮ শতাংশের নিচে নামবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আশাবাদ
বুধবার (১৪ মে) বাংলাদেশ ব্যাংকে সমসাময়িক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দুবাই থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন গভর্নর ড. মনসুর। এসময় তিনি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি, বাজেট লক্ষ্যমাত্রা, আইএমএফ ঋণ, আর্থিক খাত সংস্কারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের মতামত তুলে ধরেন।
তিনি বলেন— “আশা করছি, আগামী মাসেই মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের ঘরে চলে আসবে। আর আগামী বছরের এই সময়েই মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে। এতে করে বাজেটে যেভাবে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন করতে খুব একটা সমস্যা হবে না।”
গভর্নরের এ বক্তব্যে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে কিছুটা আশাবাদের ইঙ্গিত মিলেছে।
বাজেট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আশাবাদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বক্তব্যে স্পষ্টভাবে উঠে আসে—সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে যেসব মুদ্রানীতিগত ও আর্থিক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে, তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। ফলে ২০২5 সালের বাজেটে মূল্যস্ফীতির টার্গেট (সাধারণত ৫-৬% ধার্য করা হয়) পূরণে তেমন বড় চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে না বলে ধারণা করছেন তিনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উচ্চমূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানো, মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ ও ডলারের বাজারে হস্তক্ষেপসহ বেশ কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়েছে, যা ধীরে ধীরে কার্যকর হচ্ছে।
আইএমএফ নিয়ে আত্মনির্ভরশীল বার্তা
গভর্নর তার বক্তব্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন—
“আইএমএফের টাকা ছাড়াও আমাদের চলবে। অনেকেই অনেক কথা বলছিলেন—আইএমএফের ঋণ ছাড়া আমরা চলতে পারবো না। এসব একেবারেই ঠিক নয়। আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা রয়েছে। রিফর্ম (সংস্কার) চলতেই থাকবে।”
এই বক্তব্যে তিনি একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন—বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় যে পথ অনুসরণ করছে, তা আইএমএফের শর্ত ছাড়া হলেও অব্যাহত থাকবে, এবং দেশ নিজস্ব শক্তি ও নীতিগত সিদ্ধান্তে সামনে এগিয়ে যাবে।
মূল্যস্ফীতি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কেন এত জরুরি, তা বোঝাতে গেলে বুঝতে হবে এর প্রভাব কোথায় পড়ে। মূল্যস্ফীতি বাড়লে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্থায়ী আয়ের মানুষ, যাদের আয় বাড়ে না কিন্তু পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। খাদ্যদ্রব্য, গ্যাস, বিদ্যুৎ, ভাড়া ইত্যাদির দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায়, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এমন স্বস্তিদায়ক পূর্বাভাস দেশবাসীর জন্য আশার আলো হতে পারে, বিশেষ করে আসন্ন বাজেট সামনে রেখে যখন জনসাধারণ ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নানা ধরনের উদ্বেগ বিরাজ করছে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান নেতৃত্ব দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে নানা ধরনের রিফর্ম (সংস্কার) বাস্তবায়নের মাধ্যমে আর্থিক খাতকে স্বচ্ছ ও স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে—
নতুন মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন
ডলারের বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা
ব্যাংক খাতে লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
সুদের হার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা
আইএমএফের রিফর্ম অ্যাজেন্ডার কিছু অংশ বাস্তবায়ন করা
গভর্নরের বক্তব্যে এসব উদ্যোগেরই একটি ধারাবাহিকতা ফুটে উঠেছে।
মূল্যস্ফীতি কমে আসার এ ধরনের পূর্বাভাস নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে তা বাস্তবায়নে সময়োপযোগী পদক্ষেপ, সুসংহত অর্থনৈতিক নীতি, স্বচ্ছ ব্যাংকিং খাত, এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা—এই সব কিছুর সমন্বয় দরকার। গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের এই ঘোষণা যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে তা শুধু সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির বার্তা নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি পুনরুদ্ধারে বড় সহায়ক হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ