
ছবি: সংগৃহীত
মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বহুল প্রতীক্ষিত একটি সুখবর এসেছে। এখন থেকে তারা মালয়েশিয়ায় মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা সুবিধা পাবেন—একটি সুবিধা, যা এতদিন ১৫টি শ্রমিক-রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে কেবল বাংলাদেশিদের দেওয়া হতো না। ফলে বহুবছর ধরে হাজার হাজার বাংলাদেশি কর্মী ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা জরুরি প্রয়োজনে দেশে এসে ফের মালয়েশিয়ায় ফিরতে গিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছিলেন।
অবশেষে বাংলাদেশ সরকারের ধারাবাহিক কূটনৈতিক চাপ ও সফল আলোচনার মাধ্যমে মালয়েশিয়া সরকার মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ২০২৫ সালের ১০ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে।
বাংলাদেশ হাইকমিশন, কুয়ালালামপুর তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মালয়েশিয়ার সঙ্গে চলমান দ্বিপাক্ষিক শ্রমচুক্তি ও কর্মী কল্যাণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গত মে মাসে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল মালয়েশিয়া সফর করে। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন সরকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. আসিফ নজরুল এবং প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী।
তারা মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন, যেখানে বাংলাদেশি কর্মীদের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা না থাকার কারণে তাদের যেসব বাস্তব সংকটে পড়তে হচ্ছে, তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়।
ড. আসিফ নজরুল জানান, “বৈঠকে আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করি। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাৎক্ষণিক আশ্বাস দেন যে, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। এরপর থেকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং কুয়ালালামপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন মালয়েশিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ জুলাই ‘মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা’ সংক্রান্ত পরিপত্র জারি হয়।”
পরিপত্র অনুযায়ী, যারা আগে থেকে সিঙ্গেল এন্ট্রি ভিসা এবং বৈধ টেম্পোরারি এমপ্লয়মেন্ট ভিজিট পাশ (পিএলকেএস) পেয়েছেন, তাদের নতুন করে মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে না। তারা যখন তাদের পিএলকেএস নবায়ন করবেন, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা ইস্যু হয়ে যাবে।
এছাড়া, যেসব বাংলাদেশি কর্মীদের সিঙ্গেল এন্ট্রি ভিসা ছিল এবং তাদের পিএলকেএস এখনও বৈধ রয়েছে, তারা এখন থেকে মালয়েশিয়া ত্যাগ করে পুনরায় দেশে ফিরে আসতে পারবেন মাল্টিপল ভিসা ছাড়াও, কারণ এ সংক্রান্ত পরিপত্র মালয়েশিয়ার সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে পাঠানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছিল এতদিন। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ভিয়েতনামসহ মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো অন্যান্য দেশের নাগরিকরা মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা পেয়ে আসলেও, বাংলাদেশিদের দেওয়া হতো সিঙ্গেল এন্ট্রি ভিসা। ফলে দেশে যেকোনো প্রয়োজনে এলে পুনরায় মালয়েশিয়ায় প্রবেশের ক্ষেত্রে তাদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হতো।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, “বাংলাদেশিরা অনেক সময় মা-বাবা মারা যাওয়ার পরও দেশে ফিরে যেতে পারতেন না, কারণ ফিরে আসার ভিসা পাওয়া ছিল অনিশ্চিত। কেউ কেউ ছুটিতে দেশে এসে কয়েক মাস আটকা পড়েছেন। এখন এই সিদ্ধান্তে লাখ লাখ বাংলাদেশি স্বস্তি পাবে।”
মালয়েশিয়ার সেলাঙ্গরে কাজরত টেক্সটাইল শ্রমিক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, “গত বছর আমার মা মারা যান, কিন্তু মালয়েশিয়া ছাড়লে আবার ভিসা পাব কি না, সেই ভয়ে দেশে যেতে পারিনি। এখন থেকে অন্তত দাফনে বা বিপদে দেশে গিয়ে আবার কাজে ফিরে আসতে পারব—এটাই অনেক বড় স্বস্তি।”
কুয়ালালামপুরের একটি নির্মাণ প্রকল্পে কর্মরত জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “যত সমস্যাই হোক, আমরা কেউই কাজের সুযোগ হারাতে চাই না। এখন মাল্টিপল ভিসা থাকার মানে হচ্ছে পরিবার দেখার সুযোগ, আবার নির্ভরতায় মালয়েশিয়ায় ফিরে আসার নিশ্চয়তা।”
প্রতিনিধি দলের সফরের পর থেকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে একাধিক চিঠিপত্র, ভার্চুয়াল বৈঠক এবং সরাসরি আলোচনায় যুক্ত ছিল।
এই অবিচল সমন্বয় ও তৎপরতাতেই প্রায় এক দশকের পুরোনো এই সমস্যা সমাধান হয়েছে, যা এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সফল কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মালয়েশিয়ায় ৫ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মরত আছেন—এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার। এতদিন তাদের জন্য মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসার অভাব ছিল এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা, যা তাদের ব্যক্তি জীবনে ছিল সীমাহীন যন্ত্রণার নাম।
এই সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন প্রবাসী কল্যাণের এক অনন্য দৃষ্টান্ত, তেমনি প্রমাণ করে—দূতাবাস ও মন্ত্রণালয় আন্তরিক হলে অভিবাসীদের সমস্যার বাস্তব সমাধান সম্ভব।
এখন প্রত্যাশা একটাই—এই উদ্যোগ যেন কেবল কাগজে না থেকে বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে কার্যকরভাবে অনুসৃত হয় এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেন এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ