
ছবি: সংগৃহীত
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট কাটিয়ে ওঠা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ শিগগিরই বহুপাক্ষিক তিনটি আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থার কাছ থেকে মোট ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ পেতে যাচ্ছে। এসব অর্থ দেবে বিশ্বব্যাংক (WB), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB), এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)। জুন মাসের মধ্যেই এই ঋণ ছাড় হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
১৪ মে বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য দেন তিনি। গভর্নর বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক মোড় আনার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়ে আসছে। বিশেষ করে ডলারের বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করার বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর এবার তা বাস্তবায়নের পথে এগিয়েছে বাংলাদেশ, যা আইএমএফের দেওয়া শর্তের অন্যতম ছিল।
গতকাল মঙ্গলবার জানা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল তাদের চলমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তি একসঙ্গে ছাড় করতে সম্মত হয়েছে। আইএমএফ মূলত দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছিল—ডলারের বিনিময় হার যেন কৃত্রিমভাবে নির্ধারণ না করে বরং বাজারের চাহিদা-জোগান অনুযায়ী সেটি নির্ধারিত হয়।
এই প্রেক্ষাপটে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন যে, আজ থেকেই বাংলাদেশ বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করছে। এই পদক্ষেপকে তিনি ‘সঠিক সময়ে নেওয়া একটি সাহসী সিদ্ধান্ত’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, “বিনিময় হার এখন বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা মনে করি এখন এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে, কারণ বর্তমানে আমাদের রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও স্থিতিশীল অবস্থানে রয়েছে, এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য আগের চেয়ে উন্নত।”
তিনি আরও বলেন, “এই মুহূর্তে আমরা আশা করছি, জুন মাসের মধ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবির পক্ষ থেকে মোট ৩৫০ কোটি ডলারের ঋণ আসবে, যা আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী) প্রায় ২,৩০০ কোটি ডলারের ঘরে অবস্থান করছে। যদিও এটি পূর্বের তুলনায় অনেক কম, তবে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ায় রিজার্ভে ধস নামার সম্ভাবনা আপাতত কম।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবির এই তিন সংস্থার মোট ৩৫০ কোটি ডলারের ঋণ ছাড় হলে রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে, যা আবার ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া এই তহবিল বাজেট ঘাটতি পূরণ ও মুদ্রানীতি কার্যকর রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ উভয় সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও নীতিগত সংস্কারকে ইতিবাচকভাবে দেখছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে আইএমএফ এর ঋণ কর্মসূচির আওতায় রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য করব্যবস্থার সংস্কার, ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে, এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথ আরও প্রশস্ত হবে।
দেশের অর্থনীতির জন্য একটি সংকটপূর্ণ সময়েও বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে এমন কিছু সংস্কারমূলক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যা বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণের প্রবাহ নিশ্চিত করছে। ৩৫০ কোটি ডলারের এই নতুন ঋণ কেবল সাময়িকভাবে রিজার্ভ বাড়াবে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির ভিতও মজবুত করতে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে এই ঋণ ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও ফলপ্রসূ ব্যয় নিশ্চিত না হলে, ভবিষ্যতে ঋণের বোঝা আরও ভারী হয়ে উঠতে পারে বলেও সতর্ক করছেন তারা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ