
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ দলটির সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের অনলাইন উপস্থিতি নিষিদ্ধ করতে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় তাদের পরিচালিত সব ধরনের ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ ও অ্যাকাউন্ট, ইউটিউব চ্যানেল, টিকটক অ্যাকাউন্ট, টেলিগ্রাম চ্যানেল এবং এক্স (সাবেক টুইটার)-এর হ্যান্ডেলসমূহ বন্ধে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠি দিয়েছে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি। বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
সরকারি নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এসব প্ল্যাটফর্মে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর যেকোনো ধরনের প্রচার, প্রচারণা, সভা-সমাবেশের ঘোষণা, দলীয় বার্তা বা প্রপাগান্ডা ছড়ানো থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যমে যোগাযোগ—সবকিছুই নিষিদ্ধ। জাতীয় নিরাপত্তা এবং শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
এই নির্দেশনার ভিত্তিতে বিটিআরসি এখন আওয়ামী লীগ ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহৃত অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করে সেগুলোর লিংক ‘ব্লক’ করতে কাজ শুরু করেছে। পাশাপাশি, যেসব প্ল্যাটফর্ম (যেমন ফেসবুক, ইউটিউব, গুগল, মেটা, টিকটক, টেলিগ্রাম, এক্স) এই সেবাগুলো সরবরাহ করে, তাদের কাছেও আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। চিঠিতে বাংলাদেশের আইনি নির্দেশনা এবং সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্ট ও কনটেন্টগুলো সরানোর অনুরোধ জানানো হবে।
এর আগে গত সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন অপরাধসমূহ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। এর আওতায় এসব সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো সভা, সমাবেশ, মিছিল, প্রচারণা, নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যক্রম, বা অনলাইন প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। একইসঙ্গে এই দলগুলোর মিডিয়া প্ল্যাটফর্মেও নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এটি সরকার সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ অনুসারে কার্যকর করছে।
একই দিনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনও সাময়িকভাবে স্থগিত করে। ফলে দলটি এখন সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত রাজনৈতিক দল হিসেবে কার্যক্রম চালাতে পারছে না।
এই প্রেক্ষাপটে, ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “সরকারের হাতে সব কিছু বন্ধ করার প্রযুক্তিগত ক্ষমতা নেই। আমরা ওয়েবসাইট ব্লক করতে পারি। তবে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, এক্স—এসব প্ল্যাটফর্মের নিজস্ব নীতি ও প্রক্রিয়া রয়েছে। তাই আমরা বিটিআরসির মাধ্যমে অনুরোধ পাঠাব, তারা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলীয় প্রচারণার মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা তৈরির সুযোগ রাখতে চাই না। সরকার চায় আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকে এই প্ল্যাটফর্মগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা হোক।”
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি তাদের স্বচ্ছতা প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানিয়ে থাকে যে, সরকার থেকে পাঠানো অনুরোধ তারা কতটা বিবেচনায় নেয়। মেটার (ফেসবুকের মূল কোম্পানি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিটিআরসির অনুরোধে বাংলাদেশে ২,৯৪০টি কনটেন্টের অ্যাক্সেস সীমিত করা হয়। অন্যদিকে, গুগল জানায়, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ৪৯০টি অনুরোধে ৫,৮২৭টি কনটেন্ট সরানোর চেষ্টা করা হয়, যার মধ্যে প্রথম ছয় মাসে ৩৩৭টি অনুরোধের ৬৮.২% কনটেন্ট অপসারণ করা হয়নি।
সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে বাংলাদেশে এই প্রথম একটি বড় রাজনৈতিক দল ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর সমস্ত অনলাইন উপস্থিতি আইনত বন্ধ করা হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন এক ঘটনা, যা অনলাইন রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে ভবিষ্যতে আরও বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। তবে সরকার বলছে, এটি একটি অস্থায়ী ও আইনি ভিত্তির ওপর নেওয়া পদক্ষেপ, যা সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচার কার্যক্রমের স্বার্থেই নেওয়া হয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ