
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা হলো। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিয়েছে যে, এখন থেকে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বা এক্সচেঞ্জ রেট নির্ধারিত হবে পুরোপুরি বাজারের চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রিত আর্থিক কাঠামো থেকে অর্থনীতি প্রবেশ করল আরও মুক্ত, স্বচ্ছ এবং বাস্তবসম্মত বিনিময় ব্যবস্থার দিকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন এবং এর পেছনের যৌক্তিকতা, প্রস্তুতি এবং সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। দীর্ঘদিন ধরে বহুজাতিক সংস্থা, অর্থনীতিবিদ এবং অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষকেরা যে দাবি করে আসছিলেন—বাজারনির্ভর এক্সচেঞ্জ রেট চালু করতে হবে—অবশেষে সেটিই বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গভর্নর ড. মনসুর বলেন, “আমরা এখন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে ডলার বাজারকে পুরোপুরি বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। এর ফলে বাংলাদেশে আর কোনো একক কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় ডলারের দাম নির্ধারিত হবে না, বরং বিশ্ব অর্থনীতির বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে বাজারই জানাবে—ডলারের সঠিক মূল্য কত হওয়া উচিত।”
তিনি জানান, “এই ব্যবস্থা চালুর ফলে বাজারে ডলারের সংকট কমবে। বিনিময় হার স্বাভাবিক নিয়মে ওঠানামা করলেও দীর্ঘমেয়াদে এতে স্থিতিশীলতা আসবে। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের পূর্বাভাস নির্ভরযোগ্য হবে, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
ড. মনসুর উল্লেখ করেন, “আমরা একা নই। আমাদের পাশে আছে এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, জাইকা এবং চীন। এছাড়া আইএমএফ-এর ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ ছাড় হলে জুন মাসের মধ্যেই আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাকি ঋণগুলোও চলে আসবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও শক্তিশালী হবে।”
তিনি আশ্বস্ত করেন, “বাংলাদেশের এক্সচেঞ্জ রেট এখন থেকে বাংলাদেশেই নির্ধারিত হবে। কোনো অসাধু ব্যবসায়ী বা ব্যাংক যেন অযৌক্তিক দামে ডলার কেনাবেচা করতে না পারে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর অবস্থানে থাকবে।”
বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু চক্র বা প্রতিষ্ঠান বাজারকে অস্থির করার চেষ্টা করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তবে গভর্নর মনসুর বলেছেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পূর্ণ প্রস্তুত। বাজারে কোনো সংকট তৈরি হলে প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজে হস্তক্ষেপ করবে। কেউ বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করলে কঠোরভাবে দমন করা হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। এখন সময় এসেছে। কোনো বিভ্রান্তি বা গুজবে কান না দিয়ে অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতকে সংস্কারের পথে নিয়ে যেতে হবে।”
এক্সচেঞ্জ রেট নীতিমালার সঙ্গে সমন্বয় রেখে ব্যাংক খাতেও কড়া নজরদারি আরোপ করা হয়েছে বলে জানান গভর্নর। তিনি বলেন, “আমরা বলেছি, কোনো ব্যাংক যদি প্রভিশন সংরক্ষণ না করে, তাহলে তারা এক টাকাও লভ্যাংশ দিতে পারবে না। আগেও এই নিয়ম ছিল, কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এবার আমরা এটি বাস্তবায়ন করেছি।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা এখানে ব্যাংক রক্ষার জন্য আসিনি, এসেছি আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। কোনো ব্যাংকে অনিয়ম পেলে তার বোর্ড বাতিল করে দেওয়া হবে। প্রয়োজনে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মার্জার বা অবসায়ন করা হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নতুন সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনৈতিক নীতিমালায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এটি শুধু বাজারকে শক্তিশালী করার দিকেই পদক্ষেপ নয়, বরং একটি স্বচ্ছ, বাস্তবমুখী ও দায়িত্বশীল আর্থিক পরিবেশ তৈরির চেষ্টাও বটে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারভিত্তিক এক্সচেঞ্জ রেট অর্থনৈতিক সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এটি একদিকে যেমন রফতানিকারকদের প্রকৃত মূল্য বুঝে নিতে সহায়তা করবে, তেমনি আমদানিকারক, বিনিয়োগকারী এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনেও বিশ্বাসযোগ্যতা ও পূর্বানুমানযোগ্যতা বাড়াবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক সাহসিকতার পরিচায়ক। বহুদিন ধরে অপেক্ষমাণ এই সংস্কার অবশেষে বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এর সফলতা নির্ভর করবে বাজারে কার্যকর নজরদারি, ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা, এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃঢ়তা ও স্বচ্ছতাপূর্ণ নীতির ওপর।
ড. আহসান এইচ মনসুরের ভাষায়, “এই রেট এখন শুধু সংখ্যামাত্র নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচনের প্রতীক।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ