
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সিদ্ধান্ত ঘিরে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে আলোচনার ঝড়। আর এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন রাখে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উপ মুখপাত্র টমি পিগট গতকাল মঙ্গলবার (১৩ মে) ওয়াশিংটনে এক নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “আমরা জানি যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে, যতক্ষণ না দল এবং এর নেতাদের বিচার কার্যক্রম শেষ না হয়। তবে আমরা বাংলাদেশের কোনো একক রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করি না। আমাদের অবস্থান সব সময়ই একই—সব মানুষের জন্য ন্যায্য, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং প্রত্যেকের জন্য একটি স্বচ্ছ আইনি ব্যবস্থা বজায় রাখা।”
মতপ্রকাশ ও সংগঠনের স্বাধীনতায় জোর
টমি পিগট আরও বলেন, “আমরা বাংলাদেশসহ সব দেশের প্রতি আহ্বান জানাই তারা যেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং সব সংগঠনের স্বাধীনতাকে সম্মান করে। এসব গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করা প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের কূটনৈতিক অংশীদারিত্বকে গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান হিসেবে বিবেচনা করে। “আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কাজ করে এই অংশীদারিত্বকে আরও গভীর করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
ভারতেরও উদ্বেগ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে প্রতিবেশী ভারতও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দিল্লিতে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, “আওয়ামী লীগের ওপর কোনো উপযুক্ত ও নিরপেক্ষ পদ্ধতি অনুসরণ না করেই রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি একটি উদ্বেগজনক ঘটনা। এ ধরনের পদক্ষেপ কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকেই নয়, আঞ্চলিক শান্তি ও পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্ককেও প্রভাবিত করতে পারে।”
কীভাবে শুরু হলো নিষেধাজ্ঞার প্রক্রিয়া
সোমবার (১২ মে) বিকেলে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে বলা হয়, আওয়ামী লীগ এবং এর অধীনস্থ সব অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কার্যক্রম সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ থাকবে, যতক্ষণ না চলমান বিচারিক প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট অপরাধ প্রমাণিত বা খারিজ না হয়।
প্রজ্ঞাপনটি স্বাক্ষর করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি। এই সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তি হিসেবে সরকার উল্লেখ করে যে, “দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জ্ঞাতসারে এবং কখনো কখনো সরাসরি বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন। দুর্নীতি, রাজনৈতিক সহিংসতা, রাষ্ট্রীয় অর্থের অপব্যবহার, অবৈধ অস্ত্র সংরক্ষণ ও নির্বাচনী জালিয়াতিসহ একাধিক গুরুতর অভিযোগের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।”
নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপ
এই প্রজ্ঞাপনের ঠিক পরেই রাতেই নির্বাচন কমিশন (ইসি) আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নিবন্ধন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইসির তরফ থেকে জানানো হয়, “যেহেতু সরকারিভাবে দলটির সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বিচারাধীন, সে কারণে রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের স্বীকৃতি আপাতত স্থগিত করা হলো।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে, যেখানে ক্ষমতাসীন বা সাবেক ক্ষমতাসীন প্রধান রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ হলো এবং নির্বাচন কমিশনও তাদের নিবন্ধন স্থগিত করল।
গণতন্ত্র ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ
এই সিদ্ধান্ত ঘিরে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, রাজনৈতিক ভারসাম্য এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে যে, বিষয়টি শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, বরং এটি একটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
বিশেষ করে, যেসব রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে, তাদের কাছে এই নিষেধাজ্ঞা একধরনের অস্বস্তিকর বার্তা বহন করছে।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এই রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সরকার বলছে এটি একটি আইনি ও ন্যায়সংগত পদক্ষেপ, তবে বিরোধী মহল ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বিষয়টিকে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক বহুত্ববাদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন। আগামী দিনে এই সিদ্ধান্ত কী ধরনের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে এবং দেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচনী পরিবেশ কেমন হবে—তা এখন সবার নজরে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ