
ছবি: সংগৃহীত
চলতি অর্থবছরের ১০ মাস শেষ হতে না হতেই জাতীয় রাজস্ব ঘাটতির অঙ্ক ৭১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতি যখন স্থবিরতার চরম পর্যায়ে, ঠিক তখনই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিভক্তির সিদ্ধান্তে বিস্ফোরণ ঘটেছে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের। কর্মকর্তারা চলছে ‘কলমবিরতি’ কর্মসূচি। প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হচ্ছে, যা আগামী বাজেট ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তবায়নে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজস্ব ঘাটতির ভয়াবহতা ও মন্দা
এনবিআর সূত্র জানায়, জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। এর আগের মাসে এই ঘাটতি ছিল ৬৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা, অর্থাৎ মাত্র এক মাসে ঘাটতির অঙ্ক বেড়েছে ৫ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামানো হলেও বাস্তবতা তার কাছাকাছিও পৌঁছায়নি।
রাজস্ব আদায়ের বর্তমান গতি অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা তোলা দরকার। কিন্তু আদায়ের ধীরগতির কারণে এই গড় এখন প্রায় দ্বিগুণ হওয়ার পথে। অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, এ ধারা চলতে থাকলে বাজেট বাস্তবায়ন এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।
বিভক্তি নিয়ে অসন্তোষে গতি থমকে
রাজস্ব আদায়ে ইতিমধ্যে মন্দা চলছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতার কারণে। এর মধ্যেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বিভক্ত করে নীতিনির্ধারণী ও আদায় সংস্থা আলাদা করার অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এতে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে কর্মবিরতি শুরু করেন। তাঁদের দাবি, এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ব্যবসায়িক অংশীজন, রাজস্ব কর্মকর্তা এমনকি সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনার বাইরে গিয়ে। কোনো সমীক্ষা ছাড়াই কেবল ‘বিশেষ মহলের চাপ’ থেকে এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
আন্দোলনরত কর্মকর্তারা বলছেন, এনবিআরের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্থা বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গভীর রাতে, যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রক্রিয়াগত দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ। এতে শুধু কর্মকর্তাদের মানসিক অস্থিরতা নয়, পুরো সংস্থার কাঠামোগত ধারাবাহিকতাও ভেঙে পড়েছে। এতে ‘চেইন অব কমান্ড’ কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে, যার প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আদায়ের প্রতিটি স্তরে।
কর্মকর্তাদের বক্তব্য: রাজস্ব হারানো বাস্তবতা
‘কলমবিরতি’র কারণে গত তিন দিনে প্রায় ৩ হাজার ৮১০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়নি বলে ধারণা কর্মকর্তাদের। তাঁরা মনে করেন, এনবিআরকে এভাবে ভেঙে ফেলা হলে রাজস্ব আদায়ের কাঠামো চরমভাবে ব্যাহত হবে। এটি দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিতে ধস নামাবে।
বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আলাদা করে নীতিনির্ধারণী ও আদায়কারী সংস্থা থাকলেও এ ধরনের পরিবর্তনের আগে বিস্তৃত সমীক্ষা ও অংশীজনের মতামত নেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে তা হয়নি। কাস্টমস ও ইনকাম ট্যাক্স ক্যাডারের কেউই এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। এমনকি এনবিআর সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সুপারিশও আমলে নেওয়া হয়নি।
গবেষকদের সতর্ক বার্তা
সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, “নীতিগতভাবে এনবিআরকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, তবে তা হঠাৎ করে না করে সমন্বয়ের মাধ্যমে করা উচিত ছিল। এমন একটি সিদ্ধান্ত এমন সময় নেওয়া হয়েছে যখন রাজস্ব ঘাটতি প্রতিমাসে বাড়ছে, সামনে বাজেট আসছে। এটি বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। সংস্কার দরকার, কিন্তু অংশীজনদের সম্পৃক্ত না করে তা করা বিপজ্জনক।”
তিনি আরও বলেন, "এই সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো চাপে নেওয়া হয়েছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা উচিত। ভেতরে-বাইরে আলোচনা না করে, বিশেষভাবে রাতারাতি একটি অধ্যাদেশ জারি করা নীতিগতভাবে দুর্বল সিদ্ধান্ত।"
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, “এই সময়টায় রাজস্ব ও বাজেট প্রস্তুতির মৌসুম। এমন সময় এই ধরনের বিভক্তি নিয়ে সংকট তৈরি হলে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে। এই সংকট সমাধানে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট পক্ষদের আলোচনায় বসা উচিত।”
রাজস্ব আদায়ের তিন মূল খাতেই পতন
আলোচ্য সময়ে তিনটি বড় খাত—আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক—সব ক্ষেত্রেই রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি দেখা গেছে আয়কর খাতে, যেখানে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ২৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। আমদানি কমে যাওয়ায় অগ্রিম কর আদায় কমেছে, ভ্যাট খাতে উৎপাদন ও সরবরাহ কম থাকায় ধাক্কা লেগেছে, আবার মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকে আমানত কম থাকায় আবগারি শুল্ক থেকেও প্রত্যাশিত রাজস্ব আসছে না।
এছাড়া কিছু পণ্যে শুল্ক ছাড় দেওয়ার ফলে আমদানি শুল্কেও আয় কমেছে। যদিও এতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছে, কিন্তু সামষ্টিক রাজস্ব আদায়ে ধাক্কা স্পষ্ট।
এনবিআর প্রধানের মন্তব্য
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, “রাজস্ব আদায় সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে, বিনিয়োগ কমছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হলে রাজস্ব আয় তো কমবেই।” তিনি জানান, কর ফাঁকি রোধে, নন-কমপ্লায়েন্ট করদাতাদের শনাক্তে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে বলে স্বীকার করেন তিনি।
ভবিষ্যতের ঝুঁকি
অর্থনীতিবিদ ও রাজস্ব বিশ্লেষকদের মতে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে সামনের বাজেট বাস্তবায়ন যেমন কঠিন হয়ে উঠবে, তেমনি আন্তর্জাতিক ঋণ সংস্থাগুলোর চোখেও সরকার বিপাকে পড়বে। রাজস্ব ঘাটতির প্রভাব শুধু বাজেট নয়, উন্নয়ন প্রকল্প ও সামষ্টিক অর্থনীতি—সবখানেই পড়বে।
রাজস্ব আদায় খাতে সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু তা হতে হবে পরিপক্ব আলোচনার ভিত্তিতে, অংশীজনদের সম্পৃক্ত রেখে, পর্যাপ্ত সমীক্ষার আলোকে—এমনটাই মত সব পক্ষের। অন্যথায়, সংকট শুধু রাজস্বে নয়, পুরো অর্থনীতিতে ভয়াবহ ধাক্কা হয়ে ফিরে আসবে।
বাংলাবার্তা/এসজে