
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এবং প্যাডেলচালিত রিকশার দৌরাত্ম্য নতুন কিছু নয়। তবে গত কয়েক বছরে এই সমস্যাটি এমনভাবে বিস্তৃত হয়েছে যে, তা রাজধানীর যানজট ও সড়ক শৃঙ্খলার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি রিকশা নিয়ন্ত্রণের জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ‘রিকশা ট্র্যাপার’ নামের একধরনের ধাতব প্রতিবন্ধকতা বসিয়ে যে পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল, তা কার্যকর তো দূরের কথা, উল্টো জনগণের ভোগান্তি ও যানজট আরও বাড়িয়েছে।
সরেজমিনে রাজধানীর কাকরাইল, রমনা, ভিকারুননিসা স্কুলের গেট, পুরাতন রমনা থানা এলাকা এবং আশপাশের আরও কয়েকটি সড়কে দেখা গেছে, রিকশাচালকরা ট্র্যাপারকে খুব একটা তোয়াক্কা করছেন না। তারা যাত্রী নিয়ে ট্র্যাপার পার হচ্ছেন অনায়াসেই। কোনো রিকশা মাঝেমধ্যে আটকে গেলেও তা কয়েক মিনিটের মধ্যে টেনে পার করা হচ্ছে। বিপরীতে, প্রাইভেটকারসহ অন্যান্য ছোট যানবাহনের চাকা প্রায়ই পাংচার হয়ে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে ব্যালেন্স, আবার কেউ কেউ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ২০-৩০ মিনিটের যানজটে।
'লোক দেখানো' পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ নগরবাসী
বিশেষজ্ঞ, যানবাহনচালক ও সাধারণ নগরবাসী প্রায় সর্বসম্মতভাবে বলছেন, ‘ট্র্যাপার’ নামের এই ব্যবস্থা এক ধরনের লোক দেখানো কর্মসূচি ছাড়া আর কিছু নয়। ঢাকা শহরের প্রধান ও অপ্রধান সড়কে প্রায় ১০ লাখ রিকশার অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে এর জন্য প্রয়োজন নিবন্ধন, রুট পারমিট, এবং একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা কাঠামো— যেটি কোনোভাবেই কেবলমাত্র লোহার রড বসিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়।
বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. এহসান বলেন, “ট্র্যাপারের কারণে প্রাইভেটকারের চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। এটি রিকশা নিয়ন্ত্রণে মোটেই কার্যকর নয়। এগুলোকে আইনের আওতায় এনে একধরনের সিস্টেমে আনতে হবে। না হলে এমন ভোগান্তি চলতেই থাকবে।”
অটোরিকশা: বিদ্যুৎচাপ ও জাতীয় স্বার্থে আঘাত
অবৈধভাবে চালিত এসব ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাটারি চার্জ দিতে গিয়ে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে— এমনটাই জানিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা। দিনে যখন বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ, তখন অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জ করতে গিয়ে একাধিক এলাকায় লোডশেডিং দেখা দিচ্ছে। ফলে রিকশার দাপট কেবল যানজট ও ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা নয়, বরং জাতীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
রিকশা আটকাতে গিয়ে প্রাইভেটকার নষ্ট হচ্ছে
ট্র্যাপারের আসল ক্ষতি বেশি হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ির চালকদের। রাস্তায় ট্র্যাপারের কারণে কোথাও কোথাও গাড়ির চাকা ফেটে যাচ্ছে, ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। কাকরাইলে গাড়িচালক আলামিন মিয়া বলেন, “আমার গাড়ির চাকা ট্র্যাপারে ঢুকে পাংচার হয়ে গেল। মালিককে কী বলব? এই লোহার রড বসিয়ে সরকার কী পেতে চায়? রাস্তায় রিকশার রাজত্ব চলছে, অথচ ক্ষতি হচ্ছে আমাদের।”
ক্ষুব্ধ ট্র্যাফিক পুলিশও
মাঠ পর্যায়ের ট্র্যাফিক পুলিশরাও ক্ষুব্ধ এই অকার্যকর ‘রিকশা ট্র্যাপার’ নিয়ে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমপির একজন ট্র্যাফিক কর্মকর্তা বলেন, “এটা একেবারে বাজে ব্যবস্থা। কোনো কাজেই আসছে না। উল্টো যানজট আরও বাড়ছে। যেই উদ্দেশ্যে ট্র্যাপার বসানো হয়েছে, সেটা কোনোভাবেই পূরণ হচ্ছে না। রিকশা আটকানো যাচ্ছে না, বরং অন্য যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
নিবন্ধন ছাড়া নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আইনত অবৈধ, অথচ আজ ঢাকায় লাখ লাখ এমন রিকশা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের মতে, রিকশাগুলোকে একটি নিবন্ধন কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে, নির্দিষ্ট রুট ও সময়ভিত্তিক চলাচলের অনুমতি দিতে হবে এবং আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে।
প্রবীণ নগরপরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, “এই শহরে কোনো জিনিসই ব্যবস্থার মধ্যে নেই। যার ফলে ট্র্যাপারের মতো ব্যবস্থা হয়ে উঠছে স্রেফ 'কসমেটিক'। একটা লোক দেখানো চেষ্টা ছাড়া এর ভেতরে কার্যকারিতা কিছুই নেই।”
ভোগান্তির শিকার সাধারণ মানুষ
রিকশাচালকেরা বলছেন, তারা পেটের দোহাই দিয়ে এইসব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে ট্র্যাপার পার হচ্ছেন। কেউ কেউ ট্র্যাপারে আটকে গিয়ে হেলে-দুলে পার হচ্ছেন, আবার মাঝেমধ্যে টায়ার পাংচার হলেও থেমে থাকছেন না। রিকশাচালক মহিবুল মিয়া বলেন, “আমরা পেটের দায়ে চালাই। মাঝেমধ্যে টায়ার পাংচার হয়, কিন্তু যাত্রী তো নিয়ে যেতেই হবে। এই খাঁচা তেমন সমস্যা করে না।”
কিন্তু পথচারী এবং যাত্রীদের জন্য বিষয়টি হয়ে উঠেছে প্রতিদিনের ভোগান্তি। সড়কে ট্র্যাপারে আটকে যাওয়া যানবাহনকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট, যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের সড়কে। সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জন্য।
উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নীরবতা
ট্র্যাপার বসানোর পরিকল্পনা ও কার্যকারিতা নিয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্র্যাফিক) মো. সরওয়ারের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনি ফোন ধরেননি, এমনকি পাঠানো খুদে বার্তারও জবাব দেননি। এতে বোঝা যায়, ট্র্যাপারের ব্যর্থতা ও মাঠপর্যায়ে ক্ষোভের বিষয়টি উপরের মহল এড়িয়ে যেতে চাইছে।
কার্যকর সমাধান চাই, না লোক দেখানো উদ্যোগ
ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে ও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ‘রিকশা ট্র্যাপার’ নয়, প্রয়োজন নিবন্ধনভিত্তিক পরিকল্পিত রিকশা ব্যবস্থাপনা। লোহার রড বসিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, যদি না সেটার পেছনে কার্যকর আইন, তদারকি ও যৌক্তিক নীতিমালা না থাকে। ঢাকার যানবাহন পরিস্থিতি দিনদিন যে নাজুক হচ্ছে, তার দায় এখন আর শুধু রিকশাচালকেরা নয়— প্রশাসনিক ব্যর্থতাও সমানভাবে দায়ী। জনদুর্ভোগের শেষ কবে হবে, সেই প্রশ্নই এখন সবচেয়ে বড়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ