
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের পেস বোলিং ইউনিটে আসছে বড় পরিবর্তন। দীর্ঘদিন ধরে পেসারদের উন্নয়ন ও প্রস্তুতির দায়িত্বে থাকা নিউজিল্যান্ডের কোচ আন্দ্রে অ্যাডামসকে অবশেষে বিদায় জানিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান গতিতারকা শন টেইট। সোমবার বিসিবির দেওয়া এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
বাংলাদেশের হয়ে পেসারদের দায়িত্ব এখন থেকে পালন করবেন এই একসময়ের ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলার, যিনি ২০২৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন বিসিবির সঙ্গে। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের পেস বোলিং ইউনিটকে একটি নতুন পর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্যেই নেওয়া হয়েছে এই পদক্ষেপ।
এক নতুন যুগের সূচনা
বাংলাদেশ ক্রিকেটে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় বলেই মনে করছেন টেইট। দায়িত্ব গ্রহণের পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার এটা ভালো সময়, কিছুটা নতুন যুগও বলা যায়। এটা প্রায়ই বলা হয়, বাংলাদেশের পেসারদের মেধা আছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই মেধাকে সফলতায় রূপ দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমি জয়মুখী ক্রিকেটে বিশ্বাস করি এবং সেই মানসিকতা নিয়েই আমি কাজ করবো।”
তিনি আরও বলেন, “ফিল সিমন্সের মতো অভিজ্ঞ হেড কোচের অধীনে কাজ করার সুযোগ পাওয়া আমার জন্য একটি বড় অনুপ্রেরণা। আমি আশাবাদী, আমরা একসঙ্গে দলটিকে আরও শৃঙ্খলিত, আক্রমণাত্মক এবং প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে পারবো।”
কেন বিদায় অ্যাডামস?
২০২৩ সালের শুরুতে নিউজিল্যান্ডের প্রাক্তন পেসার আন্দ্রে অ্যাডামসকে জাতীয় দলের পেস বোলিং কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল বিসিবি। তার দায়িত্ব ছিল মূলত তাসকিন আহমেদ, শরিফুল ইসলাম, হাসান মাহমুদ, এবাদত হোসেন ও নাহিদ রানাদের নিয়ে কাজ করা এবং তাদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত করে তোলা।
তবে অ্যাডামসের কোচিং পদ্ধতি এবং কার্যকারিতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিসিবির অভ্যন্তরে অসন্তোষ ছিল। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সিরিজগুলোতে পেস বোলারদের ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের অভাব এবং ইনজুরির প্রবণতা বেড়ে যাওয়া বোর্ড কর্তাদের হতাশ করছিল। যদিও তার চুক্তি ছিল ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, তবুও সময়ের আগেই তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বোর্ড মনে করছে, পেস বিভাগের উন্নয়নে এখন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক কৌশলের প্রয়োজন।
শন টেইট: গতির প্রতীক থেকে কোচিংয়ের কৌশলবিদ
২০০০-এর দশকের মাঝামাঝিতে শন টেইট ছিলেন বিশ্বের অন্যতম দ্রুতগতির পেসার। ঘড়ির কাঁটায় ১৬০ কিমি/ঘণ্টার কাছাকাছি গতিতে বল করতে পারতেন তিনি, যা তাকে ‘দ্য ওয়াইল্ড থিং’ নামেও পরিচিত করে তোলে। অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে তিনি খেলেছেন ৩টি টেস্ট, ৩৫টি ওয়ানডে এবং ২১টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ইনজুরি তার পথ রুদ্ধ করলেও বল হাতে আগুন ঝরানোর জন্য তার খ্যাতি অম্লান।
খেলা ছাড়ার পর টেইট মনোনিবেশ করেন কোচিংয়ে। ২০২০ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় দলের বোলিং কোচের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় পাকিস্তানি পেসারদের সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং পদ্ধতিগত কাজ প্রশংসা কুড়ায়। এরপর তিনি কাজ করেন বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেও (বিপিএল) তিনি চিটাগং কিংসের প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের অনেক উদীয়মান পেসারকে কাছ থেকে দেখেছেন এবং বোর্ডের নজরে এসেছেন।
বিসিবির প্রত্যাশা ও পরিকল্পনা
বিসিবির সূত্র অনুযায়ী, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে টেইটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পেসারদের শুধু আন্তর্জাতিক ম্যাচে সফল করা নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী ফিটনেস, স্কিল ডেভেলপমেন্ট, মনোসংযোগ এবং গতি-নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য আনার বিষয়েও কাজ করবেন তিনি।
বিশেষ করে তাসকিন আহমেদ ও নাহিদ রানার মতো পেসারদের মধ্য থেকে ধারাবাহিক ম্যাচ উইনার বের করে আনার দিকে নজর দেবেন টেইট। এছাড়া যুব পর্যায়ে উদীয়মান পেসারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্যও টেইটকে ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে বিসিবির।
ক্রিকেট বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের পেস বোলিং ইউনিট নিয়ে যাদের দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ রয়েছে, তারা টেইটের নিয়োগকে ইতিবাচক বলেই দেখছেন। সাবেক পেসার মাসরাফি বিন মোর্ত্তজা বলেন, “টেইট নিজে একজন পেসার ছিলেন, যারা গতি ও আগ্রাসনে বিশ্বাস করতেন। আমাদের তরুণ পেসারদের সেই মানসিকতা দরকার। তিনি যদি সেটি তৈরি করতে পারেন, তা হলে এটি দলের জন্য অনেক লাভজনক হবে।”
বিশ্লেষকদের মতে, টেইটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ইনজুরি প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ ও বোলারদের ফিটনেস উন্নয়ন। পাশাপাশি, কন্ডিশন অনুযায়ী বলের বৈচিত্র্য আনা এবং একাধিক ফরম্যাটে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স বের করে আনা হবে তার মূল কাজ।
সামনে কী?
এ মাসের শেষদিকে টেইট দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবেন। আগামী মাসেই বাংলাদেশ জাতীয় দল ব্যস্ত সূচিতে প্রবেশ করবে, যেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ রয়েছে। সেই সিরিজগুলোতেই পেসারদের পারফরম্যান্সে টেইটের প্রভাব কতটা পড়ে তা বোঝা যাবে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে পেসারদের নতুন দিগন্ত খোলার আশায়, শন টেইটের এই অধ্যায় শুরু হচ্ছে অনেক প্রত্যাশা আর কৌতূহল নিয়ে। তাকে ঘিরে বোর্ড, খেলোয়াড় এবং সমর্থকদের প্রত্যাশা আকাশছোঁয়া—দেখা যাক, ‘দ্য ওয়াইল্ড থিং’ এবার টাইগারদের গতির জগতে কতটা ঝড় তুলতে পারেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ