
ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের ঠিক আগে এক নাটকীয় কূটনৈতিক অগ্রগতির মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের গাজায় দীর্ঘদিন ধরে হামাসের হাতে আটক মার্কিন নাগরিক ও ইসরাইলি সেনা সদস্য এডান আলেকজান্ডারকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। সোমবার (১২ মে) রাতে এই মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে হামাসের সামরিক শাখা আল কাসেম ব্রিগেড। খবরটি প্রথম প্রকাশ করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
হামাসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “এইমাত্র আল কাসেম ব্রিগেড জায়নবাদী সেনাসদস্য ও মার্কিন নাগরিক এডান আলেকজান্ডারকে মুক্তি দিয়েছে। যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে মধ্যস্থতাকারীদের তৎপরতার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হামাসের যোগাযোগের ভিত্তিতে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।”
বিশ্লেষকদের মতে, এই মুক্তি কেবল একজন জিম্মির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার নয়, বরং এটি ইঙ্গিত দেয় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নতুন কূটনৈতিক সমীকরণ তৈরির। বিশেষ করে, দীর্ঘদিন পর যুক্তরাষ্ট্র ও হামাসের মধ্যে সরাসরি সংলাপের সম্ভাবনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে যা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চরম উত্তেজনা ও অচলাবস্থার মধ্যে ছিল।
সূত্র জানায়, গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনিসে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রতিনিধিদের হাতে এডান আলেকজান্ডারকে তুলে দেয় হামাস। এরপর রেডক্রসের তত্ত্বাবধানে তাকে ইসরাইলের ভূখণ্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ তার দেশে ফিরে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের সরাসরি কূটনৈতিক চাপ এবং যুদ্ধবিরতির সম্ভাব্য নতুন পর্বের আগে বিশ্বজনমতকে প্রভাবিত করতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছে হামাস। এই মুক্তি ট্রাম্পের আসন্ন মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগমুহূর্তে কৌশলগত সফলতা হিসেবেও দেখা হচ্ছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা এবং নির্বাচনী প্রচারণার পটভূমিতে।
হামাসের একজন ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির যে সম্ভাব্য খসড়া তৈরি হচ্ছে, তাতে মানবিক করিডোর, অস্ত্রবিরতি এবং জিম্মি বিনিময় প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এডান আলেকজান্ডারের মুক্তি এই আলোচনার প্রাথমিক ফল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। একইসঙ্গে এটি যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়ায় হামাসের ইতিবাচক অংশগ্রহণের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত অ্যাডাম বোয়েলার সোমবার এক বিবৃতিতে বলেন, “এডান আলেকজান্ডারকে মুক্তি দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। আমরা আশা করি, গাজায় থাকা আরও যেসব মার্কিন নাগরিক নিহত হয়েছেন, তাদের মরদেহও যথাশীঘ্র ফিরিয়ে আনা হবে। এই বিষয়টি মানবতার প্রশ্ন, রাজনীতির নয়।”
তবে গাজায় এখনো যে বিপুল সংখ্যক বন্দি রয়েছেন, তাদের ভাগ্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলে এক আকস্মিক ও ব্যাপক হামলা চালায়। সেই হামলায় প্রায় ১,২০০ ইসরাইলি নাগরিক নিহত হন এবং অন্তত ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী, এখনো অন্তত ৫৮ জন বন্দি গাজায় রয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ইসরাইল গাজা উপত্যকার ওপর ভয়াবহ সামরিক অভিযান শুরু করে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া এই অভিযানে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৩ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ। এই ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ নারী ও শিশু।
জাতিসংঘ, রেডক্রস এবং অন্যান্য মানবিক সংস্থা এ পর্যন্ত একাধিকবার গাজায় যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা এবং বন্দি বিনিময়ের বিষয়ে আহ্বান জানিয়েছে। তবে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধ জয়ের লক্ষ্যে অভিযান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে দেশটির অভ্যন্তরেও বিক্ষোভ ও সমালোচনা বেড়েছে। জিম্মি পরিবারগুলোর একটি বড় অংশ নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছে—তারা মনে করেন, যুদ্ধ নয়, বরং বন্দিদের ফেরত আনার কূটনৈতিক সমাধান এখন জরুরি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এডান আলেকজান্ডারের মুক্তি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এটি যুদ্ধবিরতির জন্য যে গোপন আলোচনা চলছে তার প্রাথমিক সাফল্য। যদি পরবর্তী পর্যায়ে আরও বন্দি মুক্তি এবং মরদেহ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়, তাহলে তা এই ভয়াবহ যুদ্ধের অবসানের সূচনা হতে পারে।
তবে এটাও স্পষ্ট যে, এই অস্থায়ী অগ্রগতির মধ্যেও পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। যুদ্ধ থামানোর জন্য যেসব শর্তপত্র ও কূটনৈতিক প্রস্তাব হাজির করা হচ্ছে, সেগুলোর বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। প্রশ্ন এখন, এই মধ্যস্থতা কতদূর সফল হবে এবং ফিলিস্তিনি-ইসরাইল সংকটে কি এক নতুন মোড় নিতে চলেছে?
সাম্প্রতিক এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করছে, যুদ্ধকবলিত গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতির মোক্ষম চালচিত্রও প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। এডান আলেকজান্ডারের মুক্তি সেই পরিবর্তনেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ