
ছবি: সংগৃহীত
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনের অপসারণের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন এবার নতুন ও আরও কঠোর মোড় নিয়েছে। গত ১২ মে সোমবার রাত সাড়ে ৯টায় শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশন শুরু করেছেন। এর ফলে ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘ ২৮ দিন ধরে চলা অবরোধ, ক্লাস বর্জন ও বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় এবার এই অনশন কর্মসূচিকে আন্দোলনের ‘চূড়ান্ত পর্যায়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, উপাচার্য শুচিতা শরমিন শিক্ষার্থীদের সাথে কোনো ধরনের গঠনমূলক সংলাপে আসেননি, বরং পুরো সময়টায় তিনি নীরব থেকেছেন। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থী সুজয় শুভ জানান, উপাচার্যকে ইতোমধ্যেই ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, “২৮ দিন ধরে আন্দোলন চললেও তিনি আমাদের সঙ্গে একবারও বসেননি। অথচ আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে এসে এখন ফেসবুক লাইভে বক্তব্য দিচ্ছেন। এই ভণ্ডামি আমরা আর মানতে পারি না। তার মতো একজন ফ্যাসিস্ট উপাচার্যকে আমরা চাই না।”
বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে বর্তমানে এক গভীর অচলাবস্থা বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীরা জানায়, উপাচার্যের দুঃশাসন, একনায়কতান্ত্রিক মনোভাব, স্বেচ্ছাচারিতা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ ভেঙে পড়েছে। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে গত কয়েকদিনে একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন ও পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে। সোমবারের কার্যক্রমে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫টি বিভাগে নির্ধারিত পরীক্ষা থাকলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী তাতে অংশ নেননি। ক্লাস কার্যক্রমও ছিল একেবারেই স্তব্ধ।
শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে এবার শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশও একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। শিক্ষকরা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন এবং উপাচার্যের আচরণ ও কার্যকলাপে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কর্মচারীরাও তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে বলছেন, প্রশাসনের ওপর তাদের আস্থা নেই।
শিক্ষার্থী মোশাররফ হোসেন বলেন, “আমাদের ন্যায্য দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছি। কর্তৃপক্ষ বারবার উপেক্ষা করেছে। তাই বাধ্য হয়েই এখন ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে কঠোর আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের দাবিগুলো মানা না হলে আন্দোলন আরও কঠোর হবে।”
সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেন, “আগামীকাল (মঙ্গলবার) দুপুর ২টার মধ্যে যদি উপাচার্য পদত্যাগ না করেন, তাহলে দক্ষিণবঙ্গকে অচল করে দেওয়া হবে।” এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বরিশাল ও আশপাশের এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ জনগণ এবং ছাত্র-অভিভাবকদের মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আরও জানিয়েছেন, তারা ইতোমধ্যে নানা ধরনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছেন। এর মধ্যে ক্যাম্পাসে অবস্থান, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, ফেস্টুন-মিছিল, মশাল মিছিল, ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কে অবরোধ, উপাচার্যের বাসভবনে তালা লাগানো, সংবাদ সম্মেলন ও স্মারকলিপি পেশের মতো কর্মসূচি রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ ছাড়া পদত্যাগ করবেন না এবং আন্দোলনকারীদের হুমকিকে ‘সংবিধানবিরোধী আচরণ’ হিসেবে দেখছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের সম্মিলিতভাবে এমন প্রতিবাদ দেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এটা শুধু একটি ব্যক্তির অপসারণের দাবি নয়, বরং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার এক বৃহৎ আন্দোলন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কত দ্রুত এই সঙ্কট সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে পারবে। শিক্ষার্থীদের জীবন ও শিক্ষাজীবন দীর্ঘদিন ধরে স্থবির হয়ে পড়ায় বিষয়টি আর শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নেই, এটি জাতীয় পর্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। অনশনে শিক্ষার্থীদের জীবনহানির আশঙ্কাও অগ্রাহ্য করার মতো নয়। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা ও দ্রুত পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ