ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা খাতে দীর্ঘদিনের একটি জটিল সমস্যা—স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তরের অনিয়ম। এই সমস্যার সমাধানে এবার বড় পরিসরে পদক্ষেপ নিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশের ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি নির্দেশনা জারি করেছে মন্ত্রণালয়, যাদের মধ্যে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও আইনি ভিত্তি
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাময়িক অনুমতির মেয়াদ বহু আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু এরপরও তারা শিক্ষা কার্যক্রম স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর না করে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যা আইন লঙ্ঘনের শামিল।
এই চিঠিটি সাক্ষর করেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব এ এস এম কাসেম। চিঠিটি সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছে পৌঁছেছে এবং ইউজিসি এরই মধ্যে এই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পর্যালোচনা শুরু করেছে।
চিঠিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ধারা ১২(১) অনুযায়ী উল্লেখ করা হয়— “প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুমোদনের নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করতে হবে, অন্যথায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে।”
যেসব বিশ্ববিদ্যালয় শাস্তির মুখে
মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকার কয়েকটি নামী প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভাগীয় ও জেলা শহরের কিছু অপেক্ষাকৃত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ও। এদের তালিকা নিচে দেওয়া হলো:
দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ – মোহাম্মদপুর, ঢাকা
ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (UODA) – সাতমসজিদ রোড, ঢাকা
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ – সিদ্ধেশ্বরী, ঢাকা
দ্য মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি – রাজারবাগ, ঢাকা
প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি – গুলশান, ঢাকা
প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি – বনানী, ঢাকা
আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ – শ্যামলী, ঢাকা
সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি – পান্থপথ, ঢাকা
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস (BUHS) – মিরপুর, ঢাকা
নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ – সিলেট
ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি – কিশোরগঞ্জ
নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি – খুলনা
ফেনী ইউনিভার্সিটি – ফেনী
ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটি – কুমিল্লা
পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি – চট্টগ্রাম
চিটাগং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি (CIU) – চট্টগ্রাম
আইনি প্রেক্ষাপট ও পূর্ববর্তী নির্দেশনা
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ধারাগুলোতে স্পষ্ট বলা আছে—প্রতিটি অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিজস্ব জমিতে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করে সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যার মধ্যে রয়েছে ভর্তির অনুমতি স্থগিত, নতুন শাখা বা বিভাগ খোলার অনুমোদন বাতিল এবং চূড়ান্ত অনুমোদন প্রত্যাহার পর্যন্ত।
ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই বারবার সময় চেয়ে আবেদন করেছে, কিন্তু বাস্তবে স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরুর জন্য কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বললেও তা বাস্তবায়নে কোনো বাস্তব উদ্যোগ নেয়নি।
শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ ও সম্ভাব্য প্রভাব
এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। অনেকে মনে করছেন, হঠাৎ করে এ ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে।
মোহাম্মদপুরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলেন— “আমরা তো জানি না কবে স্থায়ী ক্যাম্পাস হবে। হঠাৎ করে যদি ভর্তির অনুমতি স্থগিত হয়, কিংবা ডিগ্রি নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে, তাহলে তো ভবিষ্যতটাই নষ্ট হয়ে যাবে।”
অভিভাবকরাও বলছেন, সরকার ও ইউজিসির উচিত শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে ধাপে ধাপে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত না হয়।
ইউজিসির পরবর্তী পদক্ষেপ ও সম্ভাব্য শাস্তি
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, চিঠি পাওয়ার পর ইউজিসির আইনি সেল বিষয়টি বিশ্লেষণ করছে। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা আইনি ভিত্তি ও বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে দ্রুত ঘোষণা করা হবে।
সম্ভাব্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে:
ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্সে নতুন বিভাগ খোলায় নিষেধাজ্ঞা
চূড়ান্ত অনুমোদন বাতিলের প্রক্রিয়া
ইউজিসির ওয়েবসাইটে বিশেষ সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি জারি
বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খাত একদিকে যেমন উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণে বড় ভূমিকা রাখছে, অন্যদিকে আইন ও নীতিমালার প্রতি অবহেলা এই খাতকে অনিরাপদ ও অব্যবস্থাপনায় ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এবারের কঠোর পদক্ষেপ এক নতুন বার্তা—কোনোভাবেই আইনের ব্যত্যয় বরদাস্ত করা হবে না।
এখন দেখার বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কত দ্রুত স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করে এবং ইউজিসি ও মন্ত্রণালয় কীভাবে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে আইন প্রয়োগ করে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



