
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট মার্কিন পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমানো এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির পরিমাণ বাড়ানো। বিশ্ববাণিজ্যে নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করার কৌশলের অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের আলোকে একটি খসড়া পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে।
এই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, বর্তমানে যেসব মার্কিন পণ্য বাংলাদেশ কম পরিমাণে আমদানি করে, সেগুলোর আমদানি বাড়ানো হবে। পাশাপাশি, যেসব পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক দামে রপ্তানি করে, সেসব পণ্যের ওপর শুল্ক ছাড়ের সুযোগ তৈরি করা হবে। এই পরিকল্পনায় তুলা, এলপিজি, প্রাকৃতিক গ্যাস, সয়াবিন পণ্য, গম, তেল, দুধ, ভ্যাকসিন, ফেরোয়াস স্ক্র্যাপ, জুয়েলারি, বোর্ড ও প্যানেল, স্বর্ণসহ মোট ১০০টি পণ্যের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এই তালিকায় থাকা পণ্যের ওপর বাংলাদেশ ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’ (MFN) পদ্ধতির ভিত্তিতে শুল্ক যৌক্তিক করবে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) এর সদস্য হওয়ায় MFN নিয়মের আওতায় এ সুবিধা অন্যান্য দেশকেও দিতে হবে।
২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২.২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তুলা আমদানি করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ৩৩৬.৫২ মিলিয়ন ডলারের তুলা। তুলা খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব ছিল প্রায় ৩৫.৮১ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে এ তুলার ওপর আমদানি শুল্ক আগে থেকেই শূন্য শতাংশ রয়েছে। এলপিজি আমদানির ক্ষেত্রেও চিত্র প্রায় একই রকম। ওই বছর বাংলাদেশ ১.৯ বিলিয়ন ডলারের এলপিজি আমদানি করেছে, যার মধ্যে মাত্র ৫১.৩২ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের এলপিজি এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে—যা তাদের মোট রপ্তানির মাত্র ০.২৫ শতাংশ।
এই পরিস্থিতি মাথায় রেখে সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি পরিমাণে সয়াবিন, গম ও প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির সুযোগ তৈরি করতে চায়। এছাড়াও ভ্যাকসিন ও মেডিকেল পণ্য, খনিজ ও ধাতব পণ্য এবং কৃষিভিত্তিক পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও মার্কিন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আরও নিবিড় বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় বাংলাদেশ।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, “আমরা এখনো নথিটি হাতে পাইনি, তবে দ্রুত এর আলোকে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিকে (USTR) একটি লিখিত প্রতিক্রিয়া পাঠানো হবে। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে এই প্রতিক্রিয়া পাঠানো হবে। ইতোমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্ভাব্য ১০০টি পণ্যের তালিকা তৈরিতে কাজ শুরু করেছে, যেখানে শুল্ক ছাড় দেওয়া যেতে পারে।”
সরকারের এক ঊর্ধ্বতন সূত্র জানায়, চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সরকার ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তিনটি বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের বকেয়া অর্থ পরিশোধ করেছে। ওরাকল করপোরেশনকেও শিগগিরই তাদের পাওনা পরিশোধ করা হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, সরকারি ও বেসরকারি খাতে অশুল্ক বাধা কমানো হবে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নকল সফটওয়্যার ব্যবহার থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দফতর (USTR) বাংলাদেশকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির ওপর গুরুত্ব দিতে বলেন। তারা উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ব্র্যান্ড যেমন জেনারেল মোটরসের গাড়ি, এলজি, হিউলেট প্যাকার্ড বা অ্যাপলের পণ্য ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার মাধ্যমে আমদানি করে থাকে। এই প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চায়, এসব পণ্য যেন সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয়। এতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি কমবে এবং দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।
ইতোমধ্যে বোয়িংয়ের বিমান ক্রয়ের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব। এর ফলে শুধু পণ্য নয়, সেবা খাতেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নির্ভরতা বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে, গত ৭ মে বাণিজ্য উপদেষ্টা এস কে বশির উদ্দিনের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে মার্কিন প্রতিনিধি জেমিসন গ্রেয়ার শ্রম অধিকার রক্ষা এবং ডিজিটাল বাণিজ্যে অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যাপারে বাংলাদেশকে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমার দল বাংলাদেশের কৃষি ও শিল্পখাতে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা কমানো এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিষয়ে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে।”
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর এ উদ্যোগ শুধু পণ্য বিনিময়ের পরিমাণ বাড়ানোর বিষয় নয়, বরং এটি একধরনের কৌশলগত পুনর্গঠনের ইঙ্গিত। এতে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী শিল্প যেমন তৈরি পোশাক বা ওষুধ খাতও লাভবান হতে পারে। তবে শর্ত থাকে, যদি বাংলাদেশ শ্রম অধিকার, সুশাসন ও ডিজিটাল নীতিতে আরও স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উঠে আসতে পারে।
বাংলাদেশ সরকারের এই উদ্যোগের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও দৃঢ় হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে আমদানি বৈচিত্র্য, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এবং আধুনিকায়নের দিক থেকে বাংলাদেশও লাভবান হবে। তবে এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতিমালা ও স্থানীয় শিল্প রক্ষার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাই হবে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ