
ছবি: সংগৃহীত
সরকার অবশেষে সোমবার রাতে গেজেট আকারে ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ জারি করেছে। এতে বহু প্রতীক্ষিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় এনবিআর কার্যত ভেঙে দুইটি বিভাগ গঠন করা হয়েছে—রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ। তবে সংশ্লিষ্ট আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সুপারিশ উপেক্ষা করে অধ্যাদেশটি কার্যত আগের খসড়া অনুযায়ীই চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে প্রশাসনিক এবং কাঠামোগত কিছু সামান্য পরিবর্তন ছাড়া বড় ধরনের কোনো সংশোধনী আসেনি।
এনবিআরের এ রূপান্তর দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনলেও এ সিদ্ধান্তকে ঘিরে উদ্ভূত বিতর্ক এবং প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার ঝুঁকি নতুন করে সামনে এসেছে।
নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এনবিআরের বিদ্যমান কাঠামো বিলুপ্ত করে দুইটি স্বতন্ত্র বিভাগ গঠন করা হয়েছে—একটি রাজস্ব নীতি বিভাগ, অন্যটি রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ। রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রয়োগ ও কর আহরণ পরিস্থিতির "মূল্যায়ন" করবে (পূর্বে বলা হয়েছিল “পরিবীক্ষণ”), যা এক্ষেত্রে তাদের নীতিগত ভূমিকার ইঙ্গিত দেয়।
অন্যদিকে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ হবে মূল প্রশাসনিক ও বাস্তবায়ন কাঠামো। এখানে প্রশাসনিক অনুবিভাগে অ্যাডমিন ক্যাডারের পাশাপাশি আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তারা এবং মাঠপর্যায়ের কর্মচারীরা যুক্ত থাকবেন। এতে নীতিমালার সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জনবলের মিশ্রণ ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অধ্যাদেশে আরও বলা হয়েছে, এনবিআরের বিদ্যমান জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত থাকবে এবং সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগে পদায়ন করা যাবে। পাশাপাশি, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত করে তার জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগে স্থানান্তর করা হবে।
অধ্যাদেশ জারির পরপরই আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তা আনন্দ প্রকাশ করলেও, মোট প্রক্রিয়াকে ঘিরে ব্যাপক অসন্তোষ এবং প্রতিবাদও দেখা দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ অধ্যাদেশে আংশিকভাবে তাদের কিছু দাবি প্রতিফলিত হলেও, মৌলিক ও কাঠামোগত সংস্কার ছাড়াই এনবিআর বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত হঠকারী।
তাদের মতে, গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব সংস্থা পুনর্গঠনের মতো বিষয়ে কোনো সমীক্ষা কিংবা কার্যকর স্টেকহোল্ডার আলোচনা ছাড়াই অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। এতে রাজস্ব আদায় ও প্রশাসনিক কার্যকারিতা ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—রাজস্ব প্রশাসনের কর্মদক্ষতা, গতিশীলতা এবং অভিজ্ঞতা বিবেচনা না করে ‘অভিজ্ঞতাবিহীন’ অ্যাডমিন ক্যাডারদের পদায়নের সুযোগ রেখে খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে, যা রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে দুর্বল করে তুলবে।
এছাড়া কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের কর্মকর্তারা যে পদের জন্য নির্ধারিত ছিলেন, সেখানে তাদের সংরক্ষিত রাখা হয়নি। ফলে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেও পদোন্নতির পথ সংকুচিত হয়ে গেছে।
অধ্যাদেশ জারির পরদিনই, সোমবার, আগারগাঁওয়ের রাজস্ব ভবনে ব্যাপক বিক্ষোভ করেন পাঁচ শতাধিক আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং ঢাকার বিভিন্ন কর অঞ্চল, কাস্টমস হাউস ও ভ্যাট কমিশনারেটের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দফায় দফায় বৈঠক, সভা এবং বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। এর ফলে পুরো দিনজুড়ে রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়ে।
বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের দাবি, এনবিআর বিলুপ্তির ফলে দেশের অর্থনীতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা বলেন, বিশ্বের প্রতিটি দেশে একটি স্বাধীন, কার্যকর রাজস্ব সংগ্রহকারী সংস্থা রয়েছে। বাংলাদেশে এনবিআরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ভেঙে ফেলা হলে দেশীয় রাজস্ব কাঠামো দুর্বল হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে অস্থিরতা বাড়বে।
এছাড়া, এনবিআর সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটি, অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র কমিটি কিংবা সংশ্লিষ্ট ক্যাডারদের পরামর্শ এই প্রক্রিয়ায় উপেক্ষিত হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সোমবারের কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় আজ মঙ্গলবার বিকাল ৩টা থেকে বিসিএস আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার, নন-ক্যাডার কর্মকর্তা এবং মাঠপর্যায়ের কর্মচারীদের সমন্বয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আয়োজকরা জানিয়েছেন, প্রয়োজনে এই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি দেওয়া হবে।
এনবিআরের বর্তমান কাঠামো বিলুপ্ত করে দুইটি বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত দেশে রাজস্ব প্রশাসনের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ কাঠামো নির্ধারণে প্রভাব ফেলবে। একদিকে এর মাধ্যমে প্রশাসনিক কেন্দ্রীকরণ হ্রাস এবং কর্মদক্ষতাসম্পন্ন জনবলকে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে একধরনের চেষ্টা দেখা গেলেও, অন্যদিকে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, আস্থা সংকট এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একপেশেভাব তৈরি হওয়ায় পুরো প্রক্রিয়াটিকে বিতর্কিত করে তুলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে রাষ্ট্রের রাজস্ব সংগ্রহের প্রায় একমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাকে ভেঙে নতুন কাঠামো গড়া হচ্ছে, তা কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর পূর্ণ মতামত ছাড়া সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। বরং এ সিদ্ধান্ত দুর্বলভাবে প্রয়োগ হলে তা অর্থনীতিতে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে।
সামনের দিনগুলোতে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে—রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা বজায় রেখে, ক্ষুব্ধ ক্যাডারদের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানো এবং দেশের রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করা। তা না হলে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব ঘাটতির পাশাপাশি উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নেও বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ