
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে টিকে থাকা দেশের রাজস্ব আদায়কারী প্রধান প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এনবিআর বিলুপ্ত করে নতুনভাবে গঠিত হয়েছে দুটি পৃথক বিভাগ—রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ। সোমবার (১২ মে) দিবাগত রাতে জারি করা এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআর এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ দুটিকেই একযোগে বিলুপ্ত করা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত বহুদিন ধরেই আলোচনায় থাকলেও এতদিন তা কার্যকর করা হয়নি। তবে এবার অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে দ্রুত গতিতে গৃহীত হলো একটি ঐতিহাসিক কাঠামোগত রদবদল। মঙ্গলবার (১৩ মে) বিকেলে এক ফেসবুক পোস্টে সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এই বিলুপ্তির পেছনের যুক্তিগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।
কর ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সমাধানে সংস্কার
প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, কর নীতি নির্ধারণ এবং কর প্রশাসনকে আলাদা করে ফেলা সময়ের দাবি ছিল। এর মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বার্থের দ্বন্দ্ব হ্রাস এবং দেশের করভিত্তিকে সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে বলে সরকারের বিশ্বাস।
এনবিআরের প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনোই তা নিজের নির্ধারিত রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি বলে উল্লেখ করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭.৪ শতাংশ, যা এশিয়ার সর্বনিম্ন এবং বিশ্বের গড় (১৬.৬ শতাংশ) এর তুলনায় অনেক নিচে। এমনকি প্রতিবেশী মালয়েশিয়ার অনুপাতও ১১.৬ শতাংশ। বাংলাদেশের উন্নয়ন টেকসই করতে হলে কমপক্ষে ১০ শতাংশ কর-জিডিপি অনুপাত অর্জন করতে হবে বলে সরকারের পর্যবেক্ষণ।
এক ছাতার নিচে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন: বড় সমস্যা
ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, এতদিন পর্যন্ত কর নীতি প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল এনবিআরের উপরেই। কিন্তু এটি একদিকে যেমন স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে, তেমনি অদক্ষতা ও অনিয়মও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অনেক সময় দেখা গেছে, যারা রাজস্ব সংগ্রহ করছেন, তারাই আবার নীতি প্রণয়ন করছেন—ফলে সঠিক জবাবদিহিতা তৈরি হয়নি। তারা কর খেলাপিদের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়ে জনস্বার্থকে পিছনে ফেলে দিতেও পিছপা হননি। এছাড়া, কর কর্মকর্তাদের কার্যকারিতা পরিমাপ করার কোনও বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতি ছিল না। ফলে তাদের কর্মজীবনে অগ্রগতিও ছিল মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নয় বরং প্রভাব-প্রতিপত্তির ভিত্তিতে।
দীর্ঘদিনের ব্যর্থতার পেছনের চিত্র
১. করের জাল সংকীর্ণ: কর ব্যবস্থার অদক্ষতায় বহু মানুষ কর ফাঁকি দিতে পারছেন বা আদৌ করের আওতায় আসছেন না। ফলে রাজস্ব আদায় সম্ভাবনার তুলনায় অনেক পিছিয়ে।
২. দুর্বল শাসনব্যবস্থা: এনবিআরের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, আইনের প্রয়োগে অসঙ্গতি, বিনিয়োগকারীদের জন্য বাধা সৃষ্টি এবং শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা—সব মিলিয়ে সংস্থাটি আস্থাহীনতায় ভুগছিল।
৩. আমলাতান্ত্রিক ওভারল্যাপ: অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের প্রধানই এনবিআরের নেতৃত্ব দেওয়ায় বিভ্রান্তি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং নীতিগত অকার্যকারিতা তৈরি হয়েছে।
৪. অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা: একাধিক ক্যাডার এবং পর্যায়ের কর্মকর্তা এ রকম পরিবর্তনের ফলে নিজেদের অবমূল্যায়নের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যা এক ধরনের সাংগঠনিক অস্থিরতা তৈরি করেছে।
নতুন কাঠামো কীভাবে ভিন্নতা আনবে
দুই ভাগে বিভক্ত দায়িত্ব:
রাজস্ব নীতি বিভাগ এখন থেকে কর আইন প্রণয়ন, হার নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কর বিষয়ক চুক্তি প্রণয়নের কাজ করবে।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ দেখভাল করবে কর আদায়, নিরীক্ষা ও নিয়ম রক্ষার বিষয়গুলো।
এই স্পষ্ট দায়িত্ববণ্টনের ফলে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে যোগসাজশ বা স্বার্থের সংঘাত আর থাকবে না।
সরকার কী আশা করছে এই সংস্কার থেকে?
১. বিশেষায়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধি
প্রতিটি বিভাগ তার নির্ধারিত কাজে মনোযোগী হয়ে দক্ষতাবৃদ্ধির মাধ্যমে কার্যকর ও স্বচ্ছ রাজস্ব প্রশাসন গড়তে পারবে।
২. করভিত্তি সম্প্রসারণ ও প্রত্যক্ষ কর জোরদার
আয়কর ও অন্যান্য প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ বাড়াতে সরকার পেশাদার জনবল নিয়োগ এবং ডিজিটাল ব্যবস্থার ওপর জোর দিচ্ছে। এতে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমবে, যা সামাজিক ন্যায্যতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
৩. নীতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও গবেষণা
স্বাধীন নীতি বিভাগ স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য নয় বরং প্রমাণ-ভিত্তিক ও ভবিষ্যতমুখী কৌশল গ্রহণে সহায়তা করবে।
৪. বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি
একটি স্বচ্ছ, পূর্বাভাসযোগ্য রাজস্ব নীতি এবং পেশাদার প্রশাসনের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ইতিবাচক বার্তা দেওয়া সম্ভব হবে।
আইএমএফ শর্ত এবং দ্রুত বাস্তবায়ন
জানা গেছে, এই সংস্কারের পেছনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর সংস্কার শর্ত বড় ভূমিকা রেখেছে। রাজস্ব জিডিপি অনুপাত বাড়ানো, দক্ষ প্রশাসন গঠন এবং স্বচ্ছতা আনার ক্ষেত্রে এধরনের কাঠামোগত পরিবর্তনকে আইএমএফ দীর্ঘদিন ধরেই উৎসাহিত করে আসছিল।
তবে এই রদবদলের সময় আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতামত উপেক্ষা করেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এর ফলে প্রশাসনের একাংশে অসন্তোষও তৈরি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে মোকাবেলার জন্য সরকারকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
ড. মইনুল হোসেন, কর বিশেষজ্ঞ বলেন, “সরকার যে অবশেষে এনবিআর ভাঙলো, তা সাহসী সিদ্ধান্ত। দীর্ঘদিন ধরেই একত্রে নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নকে কাঠামোগত সমস্যা হিসেবে দেখছিলাম। আলাদা বিভাগ হলে পলিসি হবে উন্নয়নমুখী, আর প্রশাসন হবে জবাবদিহিমূলক।”
মো. নাজমুল ইসলাম, ব্যবসায়ী নেতা মন্তব্য করেন, “ব্যবসায়ীরা কর দিতেও চায়, কিন্তু কর ব্যবস্থার প্রতি আস্থার বড় ঘাটতি ছিল এতদিন। প্রশাসন যদি স্বচ্ছ হয়, আমরা আরও কর দিতে প্রস্তুত।”
তবে কর কর্মকর্তা এসোসিয়েশনের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “কোনো প্রক্রিয়ায় আমাদের মতামত নেওয়া হয়নি। এতে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের চাহিদা উপেক্ষিত হয়েছে। এতে দক্ষতা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।”
এনবিআরের বিলুপ্তি নিছক একটি প্রশাসনিক রদবদল নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল। এই কাঠামো বদলে করদাতার আস্থা, রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা এবং উন্নয়নের গতিপথ—সব কিছুই নতুনভাবে নির্ধারিত হবে। তবে এই পরিবর্তন সফল করতে হলে নীতি ও প্রশাসনের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়, জনবল দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ডিজিটালাইজেশনের ওপর নির্ভর করতে হবে। সময়ই বলে দেবে, এই সিদ্ধান্ত কেবল কাঠামোগত ছিল নাকি সত্যিকারের যুগান্তকারী সংস্কার।
বাংলাবার্তা/এসজে