ছবি: সংগৃহীত
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে ভর্তুকি। সরকার চলতি অর্থবছরের জন্য এই খাতে যে পরিমাণ বরাদ্দ রেখেছিল, তা তিন গুণেরও বেশি ব্যয় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে বাড়তি ভর্তুকি দিতে হতে পারে ১১ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা, যা রাষ্ট্রের রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে নতুন করে চাপে ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
ভর্তুকির পরিমাণ ১৯৩ শতাংশ বাড়ছে
জ্বালানি বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এলএনজি আমদানির জন্য মোট ব্যয় হবে ৫৬ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। অথচ সরকার এই খাতে মাত্র ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল। ফলে ১৭ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। গত অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৩৫ কোটি টাকা, তার আগের বছরও একই রকম। সেদিক দিয়ে এবার ভর্তুকি বেড়ে যাচ্ছে ১৯৩ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় তিন গুণ।
অর্থ বিভাগের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের মধ্যেই বরাদ্দ ছাড়িয়ে গেছে ৫০০ কোটি টাকা। ফলে আগামী মাসগুলোতে ভর্তুকির চাপ আরও বাড়বে। শুধু ভর্তুকি দিয়ে এই ঘাটতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে মত দিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান। তাঁর মতে, “এটা শুধু জ্বালানি খাতের সমস্যা নয়; এটি অর্থনীতির সামগ্রিক ভারসাম্যের ওপর প্রভাব ফেলছে।”
আন্তর্জাতিক বাজার ও ডলারের দামের প্রভাব
বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজির গড় আমদানি মূল্য প্রতি এমএমবিটিইউ (MMBTU) ১০.৫০ ডলার। তবে স্পট মার্কেট থেকে কিনলে সেই দাম বেড়ে যাচ্ছে প্রায় ১৪ ডলার পর্যন্ত। এ ছাড়া প্রতি ডলার ১২৩ টাকা ধরে হিসাব করলে একেকটি কার্গোর খরচ দাঁড়াচ্ছে কয়েকশ কোটি টাকা। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতি বছর ৯৮টি এলএনজি কার্গো আমদানি করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার কারণে জ্বালানি তেলের পাশাপাশি গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজারও অস্থির। এর সঙ্গে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় আরও তীব্র হচ্ছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, “আমাদের উচিত ছিল দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে আগেই জোর দেওয়া। এখন আমরা শুধু বিদেশি বাজারের ওপর নির্ভর করে অপ্রত্যাশিত খরচে পড়ছি।”
দাম বাড়ায়, তবু লোকসান
সরকার প্রতি ঘনমিটার এলএনজি আমদানিতে খরচ করছে প্রায় ৬০ টাকা। কিন্তু এই গ্যাস শিল্প খাতে বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩১.৫০ টাকায়, আবাসিকে ১৮ টাকায় এবং সিএনজি স্টেশনে ৪৩ টাকায়। ফলে গড়ে প্রতি ঘনমিটারে সরকারের লোকসান হচ্ছে ৭ টাকা ৮ পয়সা। এই লোকসান পূরণে প্রতিবছর ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে এবং এই প্রবণতা আরও বাড়ছে।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সাবেক সদস্য মঈনুল ইসলাম বলেন, “সরকার যদি গ্যাসের দাম বাস্তব সম্মতভাবে নির্ধারণ না করে, তাহলে ভর্তুকি একসময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”
গ্যাস উৎপাদন কমছে, আমদানি বাড়ছে
এলএনজি আমদানিতে বিপুল ব্যয়ের পেছনে মূল কারণ দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের ধারাবাহিক হ্রাস। ২০২৫ সালের মার্চে দেশে দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ছিল ১,৮৬২ এমএমসিএফডি (মিলিয়ন কিউবিক ফিট পার ডে), যা ২০২৩ সালের মার্চে ছিল ২,১৭৬ এবং ২০২৪ সালের মার্চে ছিল ২,০৪০। অন্যদিকে দৈনিক চাহিদা রয়েছে ৩,৮০০ এমএমসিএফডি। ফলে দৈনিক প্রায় ১,১০০ এমএমসিএফডি ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, যা আমদানি দিয়ে পূরণ করা ছাড়া উপায় নেই।
সরকারি পর্যায়ে গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০টি নতুন কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার করা হবে, যা সফল হলে ৬৪৮ এমএমসিএফডি গ্যাস যুক্ত হতে পারে। ২০২৮ সালের মধ্যে আরো ১০০টি কূপ খননের মাধ্যমে ৯৮৫ এমএমসিএফডি গ্যাস উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় কারিগরি ক্ষতি ৫০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনাও রয়েছে।
প্রশাসনিক মন্তব্য ও নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, “সরকার শিল্প, বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রাখতে চায়। এ কারণে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্তগুলো কঠিন হলেও জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি সপ্তাহে এলএনজি কেনা নিয়ে অর্থ উপদেষ্টার নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়।”
এ বিষয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, “দেশে নতুন শিল্প হচ্ছে, কিন্তু গ্যাস সরবরাহ কমানো হয়নি। বরং বাড়তি চাহিদা মেটাতে আমাদের আমদানি বাড়াতে হচ্ছে। তাই বছরে ১১ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হলেও সেটা বর্তমান অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন।”
সমালোচনা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, এলএনজির ভর্তুকি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ঠিক না করলে এই ব্যয় জাতীয় বাজেটের ওপর অনিয়ন্ত্রিত চাপ ফেলবে। ইতোমধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে ব্যয় সংকোচনের আভাস মিলছে। জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য আমদানিনির্ভর না হয়ে দেশীয় উৎপাদনের দিকে নজর বাড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিপিডির গবেষক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “ভর্তুকির নামে যদি প্রতিনিয়ত অর্থ ঢালা হয়, তা হলে সেটা টেকসই নয়। আমাদের প্রয়োজন জ্বালানি নীতির পূর্ণ সংস্কার।”
ব্যয় বেড়েই চলেছে, সমাধান অনিশ্চিত
বর্তমানে গ্যাস খাতে আমদানি ব্যয়ের যে গতি, তা বজায় থাকলে আগামী কয়েক বছরেও এই খাতে ভর্তুকি দিতে হবে বিশাল অঙ্কে। সরকার এলএনজি আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ অগ্রিম কর প্রত্যাহার করলেও মূল সমস্যা থেকে যাচ্ছে—দেশীয় উৎপাদনের ঘাটতি এবং মূল্য কাঠামোর ভারসাম্যহীনতা।
পর্যবেক্ষকদের মতে, এখনই যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে গ্যাস খাতে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা দূর অস্ত—এটি রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির অন্যতম দুর্বল কড়ি হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



