
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চলমান তীব্র দাবদাহে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছে ভীষণ কষ্টকর। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দিনভর খর রোদ ও চড়া তাপমাত্রা, বিশেষ করে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরমের তীব্রতা যেভাবে বাড়ছে, তা জনস্বাস্থ্যের জন্য হয়ে উঠেছে মারাত্মক হুমকি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গরমে সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি হলো হিট স্ট্রোক, যা প্রাণঘাতীও হতে পারে।
তাই হিট স্ট্রোকের কারণ, লক্ষণ এবং ঝুঁকিমুক্ত থাকতে করণীয় সম্পর্কে সচেতন হওয়া এখন জরুরি। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কীভাবে হয় হিট স্ট্রোক?
মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ওপর যখন অতিরিক্ত গরম ও পানিশূন্যতার চাপ পড়ে, তখন শরীর ঘাম উৎপাদন বন্ধ করে দেয় এবং অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এই অবস্থায় শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে গেলে সেটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে হিট স্ট্রোক বলা হয়।
এই সমস্যা সাধারণত তখনই ঘটে যখন কেউ দীর্ঘক্ষণ খোলা রোদে কাজ করেন, পর্যাপ্ত পানি পান না করেন কিংবা তীব্র গরমে বিশ্রাম না নিয়ে দৌড়ঝাঁপ বা পরিশ্রম করেন।
হিট স্ট্রোকের লক্ষণ
হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে, যা দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:
মাথা ব্যথা ও মাথা ঘোরা
চোখে ঝাপসা দেখা
হঠাৎ দুর্বলতা বা শরীর ভেঙে পড়া
বমি ভাব বা বমি হওয়া
শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মাংসপেশিতে টান লাগা
অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
খিঁচুনি
এসব লক্ষণ দেখা দিলে এটি মোটেও অবহেলার বিষয় নয়। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ, শিশু, গর্ভবতী নারী ও যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগ আছে, তাদের ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোক অনেক বেশি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে কী করবেন?
এই তীব্র গরমে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কিছু সহজ কিন্তু কার্যকর নিয়ম মেনে চললে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
১. পর্যাপ্ত পানি পান
প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করুন। ঘাম বা প্রস্রাবের মাধ্যমে যে তরল বের হয়ে যাচ্ছে, সেটির ঘাটতি পূরণ করতে হবে। পানির সঙ্গে চাইলে একটু লবণ-চিনির শরবত বা ওরস্যালাইনও খেতে পারেন।
২. সরাসরি রোদ এড়িয়ে চলা
যারা শ্রমিক, রিকশাচালক, হকার বা নির্মাণকাজে যুক্ত তাদের দিনের গরম সময় অর্থাৎ সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে খোলা রোদে বেশি সময় না থাকার চেষ্টা করতে হবে। কাজের সময় আধাঘণ্টা অন্তর ছায়ায় বিশ্রাম নিতে হবে এবং বারবার ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ও শরীর ধুয়ে নিতে হবে।
৩. ঢিলেঢালা ও হালকা রঙের পোশাক
গরমে হালকা রঙের, সুতি ও ঢিলেঢালা পোশাক পড়লে শরীর সহজে শ্বাস নিতে পারে এবং ঘামের মাধ্যমে তাপ নির্গত হতে সুবিধা হয়। টাইট পোশাক গরমে শরীরের তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে তোলে।
৪. খাবারে সতর্কতা
এই সময় খোলা বাসি খাবার, রাস্তাঘাটে বিক্রি হওয়া শরবত বা চা, পানি ও ফলমূল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এগুলো থেকে ডায়রিয়া, টাইফয়েড ও হেপাটাইটিস-এ (জন্ডিস) হবার সম্ভাবনা থাকে। খাদ্য নিরাপদ ও সহজপাচ্য হতে হবে এবং বাসায় তৈরি তাজা খাবারই খাওয়া উচিত।
৫. শিশু ও বয়স্কদের বিশেষ যত্ন
শিশু ও বয়স্করা অনেক সময় বোঝাতে পারে না তারা ঠিক কেমন অনুভব করছে। তাই তাদের বারবার পানি খেতে দিতে হবে, ঘামছে কিনা দেখতে হবে এবং পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দিতে হবে। তাদের ঘরের বাইরে নেওয়া সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলাই ভালো।
হিট স্ট্রোক হলে তাৎক্ষণিক করণীয়
যদি কেউ হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয় বা এর উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে জরুরি ভিত্তিতে নিচের পদক্ষেপ নিতে হবে:
আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত ঠান্ডা ও ছায়াযুক্ত জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।
তার গায়ের টাইট পোশাক খুলে দিতে হবে এবং ঠান্ডা পানি দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিতে হবে।
ফ্যান বা এসি চালিয়ে শরীর ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করতে হবে।
শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত কমাতে মাথা, হাত, পা ও ঘাড়ে ঠান্ডা কাপড় বা বরফের প্যাক ব্যবহার করা যেতে পারে।
জ্ঞান না থাকলে মুখে পানি দেওয়া যাবে না। অজ্ঞান অবস্থায় দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়ানো যাবে না।
শুধু হিট স্ট্রোক নয়, বাড়ছে আরও রোগ
তীব্র গরম শুধু হিট স্ট্রোক নয়, বরং বিভিন্ন পানিবাহিত ও তাপমাত্রাসংবেদী রোগের প্রাদুর্ভাবও বাড়িয়ে দেয়। গরমে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিস, নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশি এবং ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ঘামের কারণে অনেক সময় ত্বকে চুলকানি, ঘামাচি, ফুসকুড়ি এবং ছত্রাকজনিত ইনফেকশন দেখা দেয়।
অতএব, শরীরের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি আশপাশের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাও জরুরি। বাড়ির চারপাশে পানি জমতে দেওয়া যাবে না, যাতে মশার প্রজনন না বাড়ে।
চিকিৎসকদের পরামর্শ
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “গরমের এই সময়টাতে পানিশূন্যতা ঠেকানোই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধু পানি খেলেই হবে না, খাবার ও বিশ্রামেও সচেতনতা রাখতে হবে।”
আর যদি শরীরে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন অনুভব করেন, যেমন—হঠাৎ মাথা ঘোরা, বমি, দুর্বলতা, হ্রাস পাওয়া ঘাম বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার প্রবণতা—তাহলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ, হিট স্ট্রোক একবার হলে তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে।
প্রচণ্ড গরমে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো সচেতনতা ও সতর্কতা। স্বাস্থ্যবানদেরও এই গরমে সাবধানে থাকতে হয়, তাই দুর্বল, অসুস্থ বা বয়স্কদের জন্য ঝুঁকি আরও অনেক বেশি। হিট স্ট্রোক প্রতিরোধযোগ্য, কিন্তু অবহেলা করলে তা হতে পারে প্রাণঘাতী। তাই গরমের সময় জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন এবং নিজেকে ও আশপাশের মানুষকে হিট স্ট্রোকসহ অন্যান্য গরমকালীন রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখুন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ