
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিলুপ্তির উদ্যোগ এবং সদ্য জারি হওয়া ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন এনবিআরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এই দাবিতে তারা তিন কার্যদিবসব্যাপী কলম বিরতির কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
গত ১২ মে (সোমবার) গভীর রাতে সরকার একটি গেজেট জারি করে নতুন একটি অধ্যাদেশ কার্যকর করে—যার মাধ্যমে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি আলাদা বিভাগ সৃষ্টি করা হয়। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআরের দায়িত্ব ও কাঠামো কার্যত পুনর্গঠন করা হয়েছে।
সরকারি ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে কেবল রাজস্ব নীতি বিভাগে কিছু শব্দগত পরিবর্তন (যেমন “পরিবীক্ষণ” শব্দের জায়গায় “মূল্যায়ন”) আনা হয়েছে এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদে অ্যাডমিন ক্যাডারের পাশাপাশি কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতে, এটি কোনো সাধারণ পুনর্গঠন নয়, বরং এনবিআরকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করার একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের অবস্থান
১৩ মে মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবনের সামনে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’-এর ব্যানারে অনুষ্ঠিত এক অবস্থান কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, “এই অধ্যাদেশ গভীর রাতে, কোনো গণশুনানি ছাড়াই, গোপনে জারি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শুধু এনবিআর নয়, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকেই বিপন্ন করে তোলা হচ্ছে।”
তারা অভিযোগ করেন, সরকার উন্নয়নমুখী অবস্থান থেকে সরে এসে আমলাতান্ত্রিক কায়দায় রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করছে, যা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে।
"এনবিআর সংস্কারে 'নিশিরাতের অধ্যাদেশ' বাতিল চাই"
এনবিআর সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির জমা দেয়া প্রতিবেদন কখনোই জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। কার স্বার্থরক্ষায় এত গোপনীয়তা ?
সংস্কার কমিটি গণমাধ্যমে বলছে- তাঁদের সুপারিশ মোতাবেক অধ্যাদেশ করা হয়নি। তাহলে সংস্কারের নামে গোপনে কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ?
৫৩ বছর ধরে সরকারের রাজস্বের প্রধান যোগানদাতা সংস্হা এনবিআর বিলুপ্ত করে দেয়া হচ্ছে; অথচ এর প্রধান অংশীজন সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী, চেম্বার, অর্থনীতিবিদ, জনগণ কারো সাথে আলোচনা করা হলো না কেন ?
গোপনে অধ্যাদেশ জারির লক্ষ্যে ছুটিরদিনে মিটিং হয়, অন্ধকারে ভেটিং হয়, মধ্যরাতে গেজেট হয়; সর্ষের মধ্যে ভূত না থাকলে এত নাটকীয়তা কেন ?
উন্নয়নমুখী সরকারের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিস্টের দোসর আমলা'চক্রের ষড়যন্ত্র ও দখলদারিত্বের শেষ কোথায় ?
জাতীয় বাজেট প্রস্তুতির সময়ে রাজস্ব আদায়ে ধ্বস নামিয়ে অর্থনীতিতে অস্হিরতা সৃষ্টির অপচেষ্টা কার প্ররোচনায় ?
আইএমএফ-সহ দাতা সংস্হাগুলোর সুপারিশ ছিল রাজস্ব নীতি পৃথক করা; কিন্তু তাঁরা কি রাজস্ব কাঠামো বিক্ষিপ্ত করে আমলাদের হাতে তুলে দিতে বলেছিল ? এতে করে যে রাজস্ব আদায় গতিশীল হবে, বাণিজ্যবান্ধব হবে- এমন ভাবনার যুক্তি কি ?
কর্মসূচিঃ
কলম বিরতিঃ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও আওতাধীন সকল দপ্তরে-
- বুধবার (১০.০০-০১.০০ টা);
- বৃহস্পতিবার (১০.০০-০৩.০০ টা);
- শনিবার (১০.০০-০৩.০০ টা)।
কর্মসূচির আওতা বহির্ভূতঃ
- আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা;
- রপ্তানি কার্যক্রম;
- জাতীয় বাজেট কার্যক্রম।
এনবিআর কর্মকর্তাদের তীব্র ক্ষোভ
পরিষদের এক মুখপাত্র বলেন, “এই ‘নিশিরাতের অধ্যাদেশ’ সরাসরি একটি প্রতিষ্ঠানকে বিলুপ্ত করে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব কাঠামোর মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আইএমএফ কিংবা অন্যান্য দাতাসংস্থার সুপারিশে রাজস্ব নীতি আলাদা করার কথা বলা হলেও, তারা কখনোই এনবিআরকে ধ্বংস করার কথা বলেনি।”
ঢাকা কাস্টমস হাউসের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “আমরা দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে সরকারের রাজস্বের প্রধান যোগানদাতা। অথচ আমাদের মতামত ছাড়াই আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করা হচ্ছে। রাজস্ব আদায়ে অভিজ্ঞতা না থাকা আমলাদের হাতে পুরো ব্যবস্থাপনা তুলে দেওয়ার কুফল জাতি শিগগিরই টের পাবে।”
অন্য এক কর কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “গোপনে অধ্যাদেশ প্রণয়ন, ছুটির দিনে মিটিং, মাঝরাতে গেজেট—এই সব নাটকীয়তা সর্ষের মধ্যে ভূতেরই প্রমাণ।”
অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্য
অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে এমন আশঙ্কা খণ্ডন করে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, “এটি এনবিআর বিলুপ্তির কোনো পদক্ষেপ নয়। কেবল প্রশাসনিক কার্যক্রমে দক্ষতা বাড়াতে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আলাদা করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ে কোনো প্রকার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।”
প্রশ্নবিদ্ধ সংস্কার প্রতিবেদন
এই সংস্কারের জন্য গঠিত ‘এনবিআর সংস্কার কমিটির’ প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। গণমাধ্যমে কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, তাদের প্রস্তাবনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়নি, বরং কিছু সুপারিশ এড়িয়ে গোপনে অন্য ধাঁচে অধ্যাদেশটি গৃহীত হয়েছে।
এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রশ্ন তুলেছেন, “সংস্কারের নামে কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হচ্ছে? সুশীল সমাজ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, এমনকি পার্লামেন্টের সাথেও কোনো আলোচনা করা হয়নি কেন?”
অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা
অর্থনীতিবিদরাও এই হঠাৎ পরিবর্তন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. জামিলুর রশীদ বলেন, “এনবিআরের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন করতে হলে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিবেচনায় নিতে হয়। এত দ্রুত, অপ্রস্তুত ও অসময়ে এটি করলে বাজেট প্রস্তুতি, রাজস্ব প্রবাহ ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।”
‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’-এর কর্মসূচি এখন দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সরকার এ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয় এবং এনবিআরের কর্মকর্তাদের উদ্বেগ কিভাবে প্রশমিত করে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দাবি আদায় না হলে ভবিষ্যতে আরও কঠোর কর্মসূচির দিকে যাবেন তারা।
সংক্ষিপ্তভাবে মূল দাবি:
নিশিরাতে অধ্যাদেশ বাতিল করতে হবে
এনবিআর বিলুপ্তির প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে
রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট ক্যাডারদের মতামত ও সম্মান বজায় রাখতে হবে
প্রশাসনিক ক্যাডারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বন্ধ করতে হবে
আন্দোলন চালাচ্ছে:
"এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ" — কাস্টমস ও ট্যাক্স বিভাগসহ এনবিআরের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম।
এই আন্দোলনের ভবিষ্যত গতিপথ আগামী বাজেট ঘোষণার সময়কে কেন্দ্র করেই নতুন মোড় নিতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ