
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক যুগান্তকারী ঘোষণায় জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ার ওপর আরোপ করা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। এই ঘোষণা তিনি দেন মঙ্গলবার (১৩ মে), সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে আয়োজিত যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি বিনিয়োগ সম্মেলনে। এই সিদ্ধান্তকে সিরিয়ার জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হিসেবে দেখা হচ্ছে, বিশেষ করে যখন দেশটি এক দশকের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক একঘরে অবস্থার মধ্যে ছিল।
সিরিয়ার সাবেক শাসক বাশার আল-আসাদের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা এবং রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলোর লক্ষ্য ছিল আসাদ সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে রাখা এবং বিদ্রোহীদের পক্ষে একধরনের কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও আসাদ সরকারের পতন না হওয়ায় এবং দেশটির সাধারণ জনগণ চরম দুর্দশায় পতিত হওয়ায়, এই নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
রিয়াদ সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, "আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা দিচ্ছি—এই সপ্তাহের শেষেই (মার্কিন) পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও তুরস্কে সিরিয়ার নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে চাই। সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে আমার বৈঠকে এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সঙ্গে আলাপে, আমি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছি যে মধ্যপ্রাচ্য পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত।"
তিনি আরও বলেন, “আমার মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি অনেক শ্রদ্ধা রয়েছে। আমি সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেব। যেন তারা উন্নতি করতে পারে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলো ছিল নির্মম। কিন্তু এখন সময় এসেছে এগিয়ে যাওয়ার।”
ট্রাম্প সিরীয় জনগণের প্রতি বিশেষ বার্তা দিয়ে বলেন, “আমি তাদের বলব, ‘গুড লাক সিরিয়া।’ সৌদি আরব যেমন তাদের সংস্কার ও অগ্রগতির মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সিরিয়াও চাইলে বিশেষ কিছু করে দেখাতে পারে। আমরা অনেক কিছু করেছি একসঙ্গে। কিন্তু আমাদের সামনে আরও উজ্জ্বল দিন অপেক্ষা করছে।”
হোয়াইট হাউজ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বুধবার সৌদি আরবে সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-সারার সঙ্গে বৈঠক করবেন ট্রাম্প। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই বৈঠককে অভূতপূর্ব বলেই বিবেচনা করা হচ্ছে। ব্রিটিশ দৈনিক লন্ডন টাইমস এর দাবি অনুযায়ী, আলোচনায় সিরিয়ার পক্ষ থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য আব্রাহম চুক্তির মডেল অনুসরণ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই বিষয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও, পর্যবেক্ষকদের মতে, যদি সিরিয়া ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে এগোয়, তবে সেটি হবে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন।
ট্রাম্পের ঘোষণার পরপরই সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে এ সিদ্ধান্তকে ‘সময়োচিত’ বলে আখ্যায়িত করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্র বাশার আল-আসাদের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের প্রতিক্রিয়ায় যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, তা সিরিয়ার সাধারণ মানুষের ওপর চরম প্রভাব ফেলেছিল। এখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই মানবিক বিবেচনায় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে আমরা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক ধরনের ভূ-কৌশলগত কূটনীতি চালু করতে যাচ্ছে। তুরস্ক, সৌদি আরব, এবং ইসরায়েলসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্কের নতুন ধারা তৈরি হতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন অপেক্ষা করছে ট্রাম্প প্রশাসনের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপের দিকে। তবে বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে বলছেন, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় ও রাজনৈতিক জবাবদিহিতা যেন উপেক্ষিত না হয়।
সিরিয়ার ওপর দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্ত শুধু একটি রাজনৈতিক ঘোষণাই নয়, বরং এটি একটি পরিবর্তনের বার্তা। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য এই ঘোষণাটি হতে পারে পুনর্গঠনের নতুন সম্ভাবনা। তবে এই পরিবর্তন কতটা বাস্তবায়িত হবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে এর প্রভাব কেমন হবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ