
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দৃশ্যপট এখন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতা পূরণে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলো নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। শুরু হয়েছে নানা জোট গঠন, দূরবর্তী সমঝোতা ও নির্বাচনি সমীকরণ গঠনের হিসাব-নিকাশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পরিস্থিতি দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে—যার কেন্দ্রে এখন বিএনপি এবং তার সম্ভাব্য জোটসঙ্গীরা।
বিএনপি এখন একচ্ছত্র শক্তি?
বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, রাজনীতির মাঠে কার্যত একচ্ছত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিএনপি নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এর পেছনে প্রধান কারণ, বিএনপির দীর্ঘদিনের আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের মুখেও টিকে থাকা এবং জনগণের মধ্যে একটি বিকল্প শক্তি হিসেবে জায়গা করে নেওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, "স্বাভাবিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, বিএনপি আগামী নির্বাচনে ব্যাপক সমর্থন নিয়ে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। এই মুহূর্তে তাদের বিপরীতে বিকল্প কোনো শক্তি গড়ে ওঠেনি।"
নতুন মুখ এনসিপি, পুরনো বিতর্ক জামায়াত, বিভাজনের রেখা কতোটা টেকসই?
রাজনৈতিক পরিসরে একটি নতুন নাম উঠে এসেছে—জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। দলটি মূলত তরুণ নেতৃত্ব, নতুন রাজনৈতিক দর্শন এবং জাতীয় সংবেদনশীলতার প্রশ্নে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করে আলোচনায় এসেছে। দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “একাত্তর আমাদের ভিত্তিমূল, চব্বিশে আমরা সেটা রিক্লেইম করেছি। এই ভিত্তিমূলকে অস্বীকার করে কেউ রাজনীতি করতে চাইলে তা বুমেরাং হবে।”
অন্যদিকে, ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এনসিপির আপাত দ্বন্দ্ব লক্ষ করা গেলেও অনেকেই মনে করছেন, পরিস্থিতি অনুযায়ী ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে সমঝোতা সম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, “রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির এখন বিরোধ দেখা গেলেও সেটা স্থায়ী না-ও হতে পারে।”
তবে জামায়াতের বিতর্কিত অতীত এবং একাত্তরের ভূমিকার জন্য এখনও দলটি রাজনৈতিকভাবে জনস্বীকৃতির সংকটে ভুগছে। মাহবুব উল্লাহ বলেন, “একাত্তর বিরোধিতার জন্য জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল। তার পরিবর্তে তারা এখনো সেই ভুল পথেই হাঁটছে। দেশের মানুষ এখনো সেই অতীত ভুলে যেতে প্রস্তুত নয়।”
স্লোগান বিতর্ক ও একাত্তরের প্রশ্নে বিভাজন
সম্প্রতি শাহবাগে একটি ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ‘আপত্তিকর’ স্লোগান ওঠাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক জগতে নতুন করে বিতর্ক দেখা দেয়। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, “জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় বাধা, ‘গোলাম আযমের বাংলা’ ধরণের স্লোগান—এসব দাগ কাটে। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করেছি, তাহলে এসব বিভাজনমূলক আচরণ কেন?”
এ বিষয়ে এনসিপি নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে জানায়, দলের কোনো সদস্য এমন স্লোগান দেয়নি। বরং তারা জাতির ঐতিহাসিক অধ্যায়গুলোর যথাযথ স্বীকৃতি চায়।
সম্ভাব্য জোট ও নির্বাচনি সমঝোতা
রাজনীতির মাঠে জোরালো আলোচনার বিষয় হচ্ছে, কে কার সঙ্গে জোট করবে। এনসিপি এবং এবি পার্টি মিলে একটি নতুন প্রগতিশীল জোট গঠনের আভাস দিয়েছেন অনেকেই। একইসঙ্গে ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যেও নির্বাচনি সমঝোতার সম্ভাবনা প্রবল। বিএনপি নিজেও এই ছোট ছোট দলগুলোকে পাশে পাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
বামপন্থি ও সেক্যুলার ধারার দলগুলো, যারা অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছিল, তারাও এখন বিকল্প শক্তি গঠনের চেষ্টা করছে। তবে এদের শক্তিমত্তা সীমিত হওয়ায় বড় পরিসরে তাদের প্রভাব ফেলতে সময় লাগবে।
আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে নতুন মেরুকরণের সুযোগ
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে চেষ্টা করছে বিভিন্ন দল। কেউ কেউ সরাসরি আওয়ামী লীগের ভোটারদের দিকেই তাকিয়ে আছে। তবে অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, “একাত্তরের পক্ষে অবস্থান নিলেই আওয়ামী লীগের সমর্থন পাবে—এটা ভাবাটা বোকামি। যারা আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগ সমর্থক, তারা সহজে বিএনপি বা ডানপন্থি দলে চলে যাবে না।”
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও সরকারের ভূমিকা
দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে এখন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রভাবও যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। ইসলামি দলগুলো সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে আবার একইসঙ্গে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের কথাও বলছে। অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, “এই দ্বৈত অবস্থানেই ভবিষ্যতে নতুন মেরুকরণ হতে পারে। বিএনপিবিরোধী মোর্চা তৈরি হলেও তা বিএনপির জনপ্রিয়তার জন্য হুমকি নয়।”
নির্বাচনি তফসিল ও রোডম্যাপ নিয়েও অনিশ্চয়তা
সবকিছুই এখন নির্ভর করছে নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার ওপর। নির্বাচন আদৌ কবে হবে, কী পদ্ধতিতে হবে—এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। তাই চাপ তৈরি হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। বিএনপি ও অন্যান্য দলগুলো নির্বাচনি রোডম্যাপ চূড়ান্ত করার দাবিতে আরও সক্রিয় হবে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, তবে সম্ভাবনার আলো
বাংলাদেশের রাজনীতির এ সন্ধিক্ষণে চলছে প্রচণ্ড অস্থিরতা। কিন্তু একইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে নতুন সম্ভাবনারও আভাস। নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের শূন্যতায় অনেকেই নিজেদের জন্য নতুন জায়গা তৈরির চেষ্টা করছে। তবে একমাত্র বিএনপি-ই এখন পর্যন্ত সুসংগঠিত ও জনসমর্থনের দিক থেকে দৃঢ় অবস্থানে আছে। তারেক রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্ব, বিএনপির রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও জনআকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করার ক্ষমতা—এই তিনে ভর করে বিএনপি একটি নতুন গণতান্ত্রিক পথ তৈরি করতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন অনেকে।
এখন প্রশ্ন একটাই—নতুন এই রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ কত দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের দিকে এগোবে? এবং সেই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যাবে কি না—তা দেখার অপেক্ষায় আছে সমগ্র জাতি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ