
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মোড় নিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগে এবং সংঘটিত গণহত্যার প্রেক্ষিতে দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটি কোনো সভা-সমাবেশ, প্রচার বা নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবে না।
আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়া মানে শুধু একটি দলের রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়া নয়—এটি একে একে বহু রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ, মেরুকরণ ও সম্ভাব্য জোট পুনর্গঠনের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন: আওয়ামী লীগের লক্ষ-কোটি ভোটারদের ভোট কার দিকে যাবে?
রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্য, চাপে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি
আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনে মূল নেতৃত্বে ছিল এনসিপি (ন্যাশনাল কনজারভেটিভ পার্টি), জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত আরও কিছু ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। দীর্ঘদিনের চাপে থাকা বিএনপি যদিও এই আন্দোলনে সরাসরি অংশ নেয়নি, তবুও তারা প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়াকে ‘জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন’ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে।
এই পটপরিবর্তনের ফলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—আওয়ামী লীগের অস্তিত্বহীনতা দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে একটি শূন্যতা তৈরি করেছে, যেটি পূরণের জন্য এখন সবাই কৌশলগতভাবে চেষ্টা করছে। প্রশ্ন উঠছে, এই শূন্যস্থান পূরণে সবচেয়ে লাভবান হবে কে?
ভোটব্যাংক এখন বিশ্লেষণের কেন্দ্রে
আওয়ামী লীগের একটি বিশাল ও সুগঠিত ভোটব্যাংক রয়েছে—বিশেষ করে শহরাঞ্চল, গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায়, এবং নির্দিষ্ট শ্রেণি-পেশার জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এই ভোটারদের সামনে এখন কঠিন প্রশ্ন: তাঁরা কি আগামী নির্বাচনে ভোট দেবে? দলে নিষেধাজ্ঞা থাকা অবস্থায় তাঁরা কাকে সমর্থন করবেন?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদের মতে, আওয়ামী লীগের ভেতরে বিএনপির ভূমিকা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কারণ বিদ্যমান দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তার, মামলার পেছনে বিএনপির মৌন সম্মতি বা সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ফলে দলটির অনেক সমর্থক বিএনপির দিকে সরাসরি ভোট দিতে আগ্রহী নাও হতে পারে। আবার জামায়াত ও এনসিপি এই ভোট নিজের দিকে টানার চেষ্টায় আছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
ভোট যাবে কার বাক্সে?
এই প্রশ্নটি এখন শুধু সাধারণ ভোটার নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিএনপি চাইবে এই ভোট নিজেদের দিকে আনতে। আবার জামায়াত বা এনসিপির মতো দলও ভাবছে, আওয়ামী লীগের বিরোধিতা ও সরকারের বিরুদ্ধে তৎপরতা দেখিয়ে তারা এই ভোটারদের মন জয় করতে পারবে।
তবে একজন নিরপেক্ষ ভোটার আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে যাকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ভাববেন, তার দিকেই ভোট ঝুঁকবে বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন। বিশেষ করে নির্বাচনী প্রচারে কে কী বার্তা দেয়, কে ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পারে—তা বড় বিষয় হয়ে উঠবে।
জোট রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ
আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে জোট গঠন, একত্রীকরণ ও সমঝোতার ব্যাপারে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে একাংশ বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনপূর্ব জোটে যাওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে। আবার কেউ কেউ স্বাধীনভাবে আসনভিত্তিক সমঝোতা করতে চায়। এনসিপির একাধিক নেতা ইতোমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছেন, তারা এককভাবে ৫০টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তবে বৃহৎ জোট গঠনের কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে দলগুলোর অবস্থান পরিষ্কার হয়ে যাবে। এখন যেহেতু নির্বাচনের নির্ধারিত তারিখ ঘোষণা হয়নি, তাই জোট বা সমঝোতা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যও জানিয়েছেন, রাজনৈতিক সংস্কার এবং নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ পরিবেশ নিশ্চিত না হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে দ্বিধান্বিত থাকবেন। তবে পরিস্থিতির উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক চাপ বিবেচনায় তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানানো হয়েছে।
নির্বাচন আদৌ হবে কি না?
যদিও অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে যে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তবে বিএনপিসহ অনেক দলের মধ্যে এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। অনেকের আশঙ্কা, দেশের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখিয়ে নির্বাচন আরও পেছানো হতে পারে, অথবা কোনো দল বিশেষ সুবিধা পেতে দেরি করানো হতে পারে।
তবে নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন পর্যায়ক্রমে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে। সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও কেন্দ্র চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে।
এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকেই রাজনীতি
আওয়ামী লীগ নামক দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন শক্তিকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত দেশের রাজনীতিকে এক অজানা পথে ধাবিত করেছে। সামরিক-বেসামরিক সরকারগুলোর ইতিহাসে এই ধরনের সিদ্ধান্ত খুবই বিরল। রাজনৈতিক দলগুলোর ভবিষ্যত কৌশল, ভোটারদের মানসিকতা এবং নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা মিলিয়ে ২০২৫ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল নির্বাচনে পরিণত হতে পারে।
কে কার সঙ্গে যাবে, কার বাক্সে পড়বে সেই ‘নিষিদ্ধ’ সমর্থকদের ভোট—এই হিসেব শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করবে নতুন নেতৃত্ব কার হাতে উঠবে, আর কে হয়ে উঠবে দেশের পরবর্তী রাজনৈতিক ভারসাম্যের নিয়ন্ত্রক।
বাংলাবার্তা/এমএইচ