
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর দেওয়া কঠোর শর্ত বাস্তবায়নের পথে বাংলাদেশ। যদিও এসব পদক্ষেপের উদ্দেশ্য অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী করা, তবে এর প্রভাবের ধরন স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনে নতুন চাপ হিসেবে দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির হারে আবারও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ফলে তার দাম বাড়বে, বিপরীতে কমবে টাকার মান। এমন অবস্থায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। খাদ্য, জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরাসরি প্রভাব পড়বে বাজারে। সাধারণ মানুষের ব্যয় বাড়বে, কিন্তু আয় বাড়বে না।
আইএমএফের শর্তের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ডলারের নির্ধারিত হার তুলে দিয়ে বাজার-নির্ধারিত বিনিময় হারে ফিরে গেছে। এরই মধ্যে গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার ডলার কেনাবেচা হয়েছে ১২২-১২৩ টাকার মধ্যে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডলারের ওপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। কোনো ব্যাংক যেন কারসাজির মাধ্যমে অতিরিক্ত দাম না চায়, সে লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তবে বাজারের অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কিছু ব্যাংক রেমিট্যান্স কিনছে ১২২ টাকায় এবং বিক্রি করছে ১২৩ টাকায়। যদিও অধিকাংশ ব্যাংকে ডলারের দাম এখনো ১২২ টাকার মধ্যে রয়ে গেছে, আগাম লেনদেনে এ হার আরও বেড়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এর ফলে সুদের হার বেড়ে গেছে, টাকা সরবরাহ সীমিত করা হয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে যাওয়ায় বিনিয়োগের গতি কমে যাচ্ছে। একইসঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত হচ্ছে।
গত কয়েক মাসে দেশের আর্থিক খাতে সুদের হার বৃদ্ধি ও তারল্য সংকটের কারণে বেসরকারি উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা নতুন ঋণ পাচ্ছেন না। ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত সুদ চাচ্ছে, আবার অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় তারল্য নেই। এতে কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে, যা দেশের তরুণ ও মধ্যবয়সী বেকার জনগোষ্ঠীর হতাশা বাড়াচ্ছে।
আইএমএফের অন্যতম শর্ত হলো— বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা। সরকারের তরফ থেকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে ঘাটতি মোকাবেলায় দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। ফলে বিদ্যুৎ ব্যয় বাড়ার অর্থ, উৎপাদন খরচ বাড়বে, আর তা সরাসরি প্রভাব ফেলবে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাতে যেকোনো মূল্যবৃদ্ধি কাঁচামাল থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। এতে দ্রব্যমূল্যের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে এবং মূল্যস্ফীতির হার ফের ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে।
আইএমএফের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ নীতির অংশ হিসেবে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ কমাতে বাধ্য হতে পারে। বিশেষ করে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা সহায়তা ইত্যাদি খাতে বরাদ্দ কমে গেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমে যাবে, ফলে বাজারে চাহিদাও কমবে। কিন্তু অপরদিকে সরবরাহ মূল্যের চাপ বাড়ায় পণ্যের দাম কমবে না। এর ফলাফল হিসেবে মূল্যস্ফীতির বাস্তবতা আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, তারা ব্যাংকগুলোর ডলার লেনদেনের ওপর কঠোর নজরদারি চালাবে। কোনো ব্যাংক যদি অতিরিক্ত ডলার দাম বাড়িয়ে মুনাফা করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে ব্যাংকগুলোর ডলার সংকট মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজে ডলার সরবরাহ করবে।
তবে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়বে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক আশাবাদী যে, বাজারে ডলারের সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করবে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ডলারের দাম যেকোনো বৃদ্ধি তাৎক্ষণিকভাবে আমদানি ব্যয়ে চাপ সৃষ্টি করে এবং তা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে।
২০২২ সালের মার্চ থেকে বৈশ্বিক মন্দার ধাক্কায় দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। আগস্টে তা ৯ শতাংশ ছাড়ায়, ২০২৩ সালের জুলাইয়ে সর্বোচ্চ ১১.৬৬ শতাংশে পৌঁছে যায়। এরপর বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর একাধিক কঠোর পদক্ষেপের ফলে তা কিছুটা কমেছে। এপ্রিল ২০২৫-এ তা ৯.১৭ শতাংশে নামলেও এখনো তা নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।
সরকার ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ বন্ধ, কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ এবং বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আইএমএফের শর্তমতো বাজারমুখী বিনিময় হার, ভর্তুকি হ্রাস, সুদের হার বৃদ্ধি ও সামাজিক ব্যয় সংকোচনের কারণে এই সুফল ধরে রাখা কঠিন হতে পারে।
তবে শুধুই নেতিবাচক নয়, আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। যেমন—রাজস্ব আদায় বাড়বে, ফলে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। ব্যাংক খাতে সংস্কার হবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে, আর্থিক খাতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে।
আইএমএফ দীর্ঘমেয়াদি টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এসব শর্ত প্রয়োগ করছে। তবে এর বাস্তবায়নে যে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বে, সেটিও মাথায় রাখা জরুরি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার যে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে তা স্বল্পমেয়াদে কার্যকর হলেও, আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের ফলে নতুন করে মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। একদিকে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে, অন্যদিকে পণ্যমূল্য বেড়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ছে। এখন প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা, যা একদিকে অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করবে, আবার অন্যদিকে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ