
ছবি: সংগৃহীত
গত ৯ মাসে বাংলাদেশে "জুলাই যোদ্ধা" পরিচয়ে রাজপথে সক্রিয় হয়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের ওপর সহিংসতা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)-এর ফ্যাক্টচেক ও মিডিয়া বিশ্লেষণ টিম বাংলাফ্যাক্ট সম্প্রতি একটি অনুসন্ধান চালিয়ে এই উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে অন্তত ৩৮টি পৃথক হামলার ঘটনা ঘটে, যেগুলোর বেশিরভাগেই পাওয়া গেছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ। এই হামলাগুলোর মধ্য দিয়ে শুধু শারীরিক ক্ষতিই নয়, রাজনৈতিক অস্থিরতার ভয়াবহ প্রতিফলনও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এই সহিংস ধারাবাহিকতার সর্বশেষ এবং সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাহরিয়ার আলম সাম্যর নৃশংস হত্যা। তিনি স্যার এ এফ রহমান হল শাখা ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন এবং “জুলাই যোদ্ধা” হিসেবে পরিচিত আন্দোলনকর্মীদের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে তিনি নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ড পুরো ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
বাংলাফ্যাক্টের অনুসন্ধান অনুযায়ী, এই ৩৮টি হামলায় নিহত হয়েছেন মোট ২ জন, আহত হয়েছেন অন্তত ৮৭ জন শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকর্মী। আহতদের অনেকেই মারাত্মক জখম নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং অনেকের শরীরে স্থায়ীভাবে ক্ষতের দাগ রয়ে গেছে। অনুসন্ধানে প্রকাশ, এসব হামলার লক্ষ্য ছিল মূলত এমন সব শিক্ষার্থী যারা সরকারবিরোধী ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, বিশেষত জুলাই মাসে কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত হওয়া বিভিন্ন আন্দোলনের নেতাকর্মীরা।
এ ধরনের সহিংসতার একটি বড় উদাহরণ উঠে এসেছে গত ৭ ফেব্রুয়ারির ঘটনায়, যেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়ি ঘেরাওয়ের সময় পুলিশের সহায়তায় হামলা চালানো হয়। সেই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আবুল কাসেম নামের এক যুবক চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
বাংলাফ্যাক্টের গবেষণা সবচেয়ে ভয়াবহ যে দিকটি সামনে এনেছে তা হলো, ৩৮টি হামলার মধ্যে অন্তত ২৮টিতে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এ ধরনের নির্যাতন ও হামলার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দলীয় শাসকগোষ্ঠী বা তাদের সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের নাম উঠে এসেছে। হামলার ধরন ছিল সংঘবদ্ধ আক্রমণ, পরিকল্পিত হামলা, এবং রাজপথে হঠাৎ সংঘটিত সহিংসতা।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, শুধু শারীরিক হামলা নয়, জুলাই যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে চালানো হচ্ছে অপপ্রচার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চালানো হচ্ছে বিভ্রান্তিকর পোস্ট, গুজব, এবং মানহানিকর প্রচারণা। বাংলাফ্যাক্ট জানায়, এ অপপ্রচারের মাধ্যমে হামলাগুলোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয় এবং সামাজিক বিভাজন আরও গভীর হয়।
বাংলাফ্যাক্ট দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে ভুয়া খবর, গুজব এবং অপপ্রচার প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি শুধু গুজব খণ্ডনই নয়, বরং অনুসন্ধানমূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাস্তব ঘটনার প্রকৃত চিত্র জনগণের সামনে তুলে আনার চেষ্টা করছে। এ অনুসন্ধানটি তারই অংশ। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, সহিংসতার ধারাবাহিকতা থামাতে না পারলে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক সহনশীলতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এই রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য এবং বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যাচ্ছে, রাজনীতির নামে দেশের তরুণ প্রজন্মের ওপর একটি সুপরিকল্পিত দমননীতির ইঙ্গিত মিলছে। "জুলাই যোদ্ধা"দের ওপর হামলার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যে বড় ভূমিকা রাখছে, তা শুধু নিহত কিংবা আহতদের সংখ্যাতেই নয়, বরং গোটা প্রক্রিয়ার পেছনের কৌশলগত বাস্তবতাতেও প্রতিফলিত হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন উঠছে—এই সহিংসতার অবসান কীভাবে সম্ভব? কতটা প্রস্তুত রাষ্ট্র ও সমাজ এমন রাজনৈতিক সন্ত্রাস রুখে দেওয়ার জন্য?
বাংলাবার্তা/এমএইচ