
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতের ‘পুশইন’ বা অননুমোদিত বাংলাদেশি নাগরিককে জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোর ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা চেয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। শনিবার (১৭ মে) সুন্দরবনের শ্যামনগরে বিজিবির নতুন ‘বয়েসিং ভাসমান বিওপি’র (বর্ডার আউটপোস্ট) উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সীমান্তে বসবাসরত জনগণ যদি তৎপর থাকে এবং বিজিবিকে তাৎক্ষণিকভাবে জানায়, তাহলে টহল টিম দ্রুত পৌঁছে পুশইন ঠেকাতে পারবে।”
শ্যামনগরে রায়মঙ্গল নদীতে বিজিবির এই নতুন ভাসমান বিওপি উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিজিবির সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, যশোর রিজিয়ন কমান্ডার, খুলনা সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার, নীলডুমুর ব্যাটালিয়নের অধিনায়কসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সৈনিকরা।
বিজিবি ডিজি বলেন, “রায়মঙ্গল নদী ও এর সঙ্গে যুক্ত বোয়েসিং চ্যানেল দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চোরাচালানের একটি সক্রিয় চক্র কাজ করছিল। এই চক্রকে নিয়ন্ত্রণে আনতেই এখানে তৃতীয় ভাসমান বিওপি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।” উল্লেখ্য, ভাসমান বিওপিটি সম্পূর্ণভাবে দেশে, নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ডে নির্মিত হয়েছে এবং এটি এখন কার্যক্রম শুরু করেছে।
পুশইন নিয়ে বিজিবি প্রধান বলেন, “মূলত যেসব এলাকা দিয়ে পুশইন বেশি হচ্ছে, তা হলো সিলেটের বিয়ানীবাজার, শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ অঞ্চল এবং উত্তরের কুড়িগ্রাম জেলার চরাঞ্চলসমূহ। পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব অংশে জনবসতি কম, সেখানেও কিছুটা পুশইন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “সত্যি কথা বলতে আজ শনিবার সকালেও কিছু পুশইনের ঘটনা ঘটেছে। আমাদের সীমান্ত এতটাই বিস্তৃত যে প্রতিটি পয়েন্টে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা বাস্তবিক দুষ্কর। এজন্য আমরা স্থানীয় জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা করছি এবং আনসারের সহায়তাও নিচ্ছি।”
বিজিবি ডিজি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “পুশইন একটি নিয়মবহির্ভূত কাজ। আমরা চাই যদি কেউ প্রকৃত বাংলাদেশি নাগরিক হন এবং ভারতে অবস্থান করেন, তাহলে তার প্রত্যাবাসন যেন একটি সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়—যেমন হস্তান্তর-গ্রহণ পদ্ধতি। এতে দুই দেশের জন্যই স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত হয়।”
তিনি জানান, বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের নিকট বারবার উত্থাপন করেছে। একই সঙ্গে বিজিবি নিয়মিতভাবে ফ্ল্যাগ মিটিং, প্রতিবাদলিপি প্রদান এবং অন্যান্য কূটনৈতিক রুটিন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রত্যাগতদের সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজিবি প্রধান বলেন, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা বলছে, তারা বহু বছর আগে ভারতে গমন করেছিল। অনেকের মুখে বলা হচ্ছে যে তাদের আইডিকার্ড বা আধারকার্ড ছিল, কিন্তু সেগুলো রেখে দেওয়া হয়েছে। আমরা বাস্তবে তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারছি না।”
পুশইনের সঙ্গে অপরাধীদের প্রবেশের সম্ভাবনা রয়েছে কি না জানতে চাইলে বিজিবি ডিজি বলেন, “কোনো সম্ভাবনাকেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সব সময়ই সতর্ক থাকতে হয়। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে—দেশ এবং জাতির জন্য ক্ষতিকর কোনো কিছু যাতে না ঘটে, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রাখা।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের রিভারাইন বর্ডার গার্ড ইউনিট মূলত সুন্দরবন এলাকার জলসীমায় নজরদারি, চোরাচালান রোধ এবং অপরাধ প্রতিরোধে নিয়োজিত। নতুন বিওপি স্থাপনের ফলে এই তৎপরতা আরও জোরদার হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।”
বিজিবি ডিজি জনগণকে এই কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত হতে উৎসাহিত করে বলেন, “জনগণ যদি সীমান্ত এলাকায় অস্বাভাবিক কোনো গমনাগমন লক্ষ্য করে, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে পেট্রোল টিমকে জানালে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। আমরা চাচ্ছি একটি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করতে।”
সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় জনগণের অংশগ্রহণ, আনসার বাহিনীর সমন্বয় এবং নতুন অবকাঠামোর মাধ্যমে বিজিবি এখন আরও আধুনিক ও দক্ষ সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীতে রূপ নিচ্ছে—এমন বার্তা দিতেই, সম্ভবত এই ভাসমান বিওপির উদ্বোধন ছিল এক কৌশলগত পদক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ