
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে সম্পর্ক ক্রমেই শীতল হয়ে উঠছে। এক সময় রাজপথ থেকে নির্বাচন—সব ক্ষেত্রেই পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হলেও সাম্প্রতিক সময়ে দল দুটির মধ্যে মতবিরোধ প্রকট হয়েছে। রাজনৈতিক কৌশল, আদর্শিক অবস্থান, নির্বাচনী প্রস্তুতি, এমনকি নেতৃত্বের উচ্চাভিলাষ—সবকিছু মিলে দুই দলের দূরত্ব এখন দৃশ্যমান এবং বাস্তব।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের লন্ডনে বৈঠক হয়েছিল, যা প্রথমে দুই দলের সম্পর্কের বরফ গলানোর ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু সূত্র বলছে, সেই উষ্ণতা স্থায়ী হয়নি। আদর্শিক ফারাক ও বাস্তব রাজনৈতিক সমীকরণ, বিশেষ করে নির্বাচন সামনে রেখে ভিন্ন কৌশল, দুই দলকে আবারও মুখোমুখি অবস্থানে এনে ফেলেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "জামায়াত এখন নিজেদের বিরোধী রাজনীতির কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তারা একটা ভাব করছে যেন সামনে তারাই ক্ষমতায় যাবে। এ কারণে আমাদের উপদেশ দেওয়ার মতো আচরণ করছে।"
জামায়াত ও তাদের ছাত্রসংগঠন শিবির সম্প্রতি কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিএনপির চেয়ে বেশি সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যমুনার সামনে আয়োজিত কর্মসূচিতে জামায়াতের শক্তিশালী অংশগ্রহণে বিএনপি বিরক্ত। এ নিয়ে বিএনপির তরফ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়াও এসেছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, "আমরা সুসংগঠিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে বিশ্বাসী। কোনো গোষ্ঠীর উগ্র বক্তব্য বা উসকানিমূলক কাজ আমাদের পথে বিভ্রান্তি আনবে না।"
অন্যদিকে, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, "মতপার্থক্য থাকতেই পারে, তবে আমরা বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম এবং থাকব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু প্রচারণা থাকলেও তা আমাদের দলীয় অবস্থান নয়।"
দুই দলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ফারাক দেখা যাচ্ছে সাংবিধানিক সংস্কার ও নির্বাচনী কৌশল নিয়েও। জামায়াত ১৯৭২ সালের সংবিধান সম্পূর্ণ বাতিল করে ইসলামী ভাবধারাভিত্তিক নতুন কাঠামোর পক্ষে, যেখানে তারা সংসদের দুই কক্ষের প্রবর্তন ও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চায়। বিএনপি সেই তুলনায় তুলনামূলকভাবে বাস্তববাদী অবস্থানে থেকে ৭২-এর সংবিধানের সংশোধনপন্থী।
জামায়াত ভোটার বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৭ করার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা বলছে, এতে তরুণদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়বে। বিএনপি এ অবস্থানের বিরোধিতা করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, "ভোটার বয়স কমিয়ে তরুণদের প্রলোভনে ফেলাই এখন জামায়াতের কৌশল। এতে গণতন্ত্রের মান ক্ষতিগ্রস্ত হবে।"
বিশেষত ছাত্রদল ও শিবিরের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও তীব্র। বিএনপির অভিযোগ, জামায়াত নতুন করে 'জাতীয় নাগরিক পার্টি'র (এনসিপি) ব্যানারে শিক্ষাঙ্গনে প্রভাব বাড়াতে চায়, যা ছাত্রদলকে কোণঠাসা করে দিচ্ছে।
ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল বলেন, "শিবির তাদের অতীতের উগ্র অবস্থান থেকে বের হতে পারেনি। তারা আবার সেই ইতিহাস ফিরিয়ে আনতে চাইছে। নতুন প্রজন্ম এ ধরনের রাজনীতি পছন্দ করছে না।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যাকাণ্ড নিয়েও জামায়াতপন্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত। বিএনপির অভিযোগ, এসব কর্মকাণ্ড বিএনপির ইমেজ ক্ষুন্ন করছে।
বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায় এবং সংস্কারের পর নির্বাচনে যেতে চায়। জামায়াত নির্বাচন বিলম্বিত করে নিজেদের সংগঠিত করতে চাইছে বলে বিএনপির অভিযোগ।
বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা বলেন, "জামায়াত গোপনে সকল আসনে প্রার্থী প্রস্তুত করছে। তারা নিজেদের বড় বিরোধী দল প্রমাণের চেষ্টা করছে। এটা রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়।"
জামায়াতের আমির এক অনুষ্ঠানে বলেন, "যখন জনগণের রক্ত শুকায়নি, যখন নেতাকর্মীরা হাসপাতালে, তখন কেউ যদি নির্বাচনের কথা তোলে, জাতি তা গ্রহণ করবে না।"
এর জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, "যারা জনসমর্থন হারিয়েছে, তারাই নির্বাচন ভণ্ডুল করতে চায়। আমরা গণতান্ত্রিক ধারায় বিশ্বাস করি।"
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, "বাংলাদেশে দুটি রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে যখন ঐক্যহীনতা তৈরি হয়, তখন সংকট গভীরতর হয়। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা দ্বিতীয় স্তরে পড়ে যায়। এখন সময় ঐক্যের, বিভেদ নয়।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, "জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে আদর্শিকভাবে বিশাল ফারাক। অতীতের জোট অনেকটা কৌশলগত ছিল। কিন্তু বাস্তব রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ সামনে এলে বিভেদ প্রকট হয়ে পড়ে।"
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, "দুই দলই বর্তমানে রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে আছে। সেখানে কৌশলগত মতবিরোধ হওয়াই স্বাভাবিক। তবে এতে বিরোধী রাজনীতির ঐক্য ভেঙে পড়তে পারে।"
বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্কের টানাপড়েন এখন আর আড়ালের বিষয় নয়। কৌশলগত সমন্বয়ের অভাব, আদর্শিক বিভাজন এবং নেতৃত্বের উচ্চাশা—সব মিলিয়ে দুই দলের মধ্যে এক ধরনের ঠান্ডা প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ যে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে, তা এখন স্পষ্ট। সংকট নিরসনে দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কী পদক্ষেপ নেয়—তা-ই এখন মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ